Breaking News

ঈদুল আজহার ঐশী আহ্বান

 মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
আনন্দ ও ত্যাগের সওগাত নিয়ে বিশ্ব মুসলমানের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ঈদুল আজহা। ‘ঈদুল আজহা’ মানে কোরবানির আনন্দ, ত্যাগের উৎসব।
ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.) যেমন নিজেদের কোরবানি করেছিলেন, তেমনি আমাদের সহায়-সম্পদ, জান-মাল সবকিছুই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে হবে অকাতরে-হাসিমুখে, আনন্দ ও উৎসবের আমেজে-এটাই ঈদুল আজহার ঐশী আহ্বান। কে কত বেশি, কার আগে নিজের সহায়-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে পারে- এ প্রতিযোগিতারই আনুষ্ঠানিক নাম ‘ঈদুল আজহা’। কয়েক হাজার টাকায় ভাগে অথবা একা পশু কোরবানিই ঈদুল আজহার মূল উদ্দেশ্য নয়। গোস্ত খাওয়া কিংবা নামমাত্র বিলানো অথবা পশুর রক্তঝরানো আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ চান তার বান্দাদের মধ্যে কারা তাকে ভয় করে, ভালোবেসে নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে পৃথিবীর বুকে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। ত্যাগ ছাড়া পশুর রক্তঝরানো যে বৃথা উৎসব ছাড়া কিছু নয় এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘লাইয়ানা লাল্লাহু লুহুমুহা, ওয়ালা দিমাউহা, ওয়ালা কিয়্যানা লাহুত-তাকওয়া। কান খাড়া করে শোন মানুষ! তোমারা যে পশু কোরবানি করছ তার রক্ত, মাংস কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের প্রেম-ত্যাগ ও তাকওয়া। ’
আফসোস! আমাদের মধ্যে ত্যাগের কোরবানি তো নেই-ই যা আছে তাও লোক দেখানো, আভিজাত্যের বড়াই, বংশীয় গৌরব, ঐতিহ্যের প্রতীকসহ নানান অনুসঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন কোরবানি দিই মানুষকে দেখানোর জন্য। নিজেকে বড় করে প্রচার করার জন্য। ফলে কোরবানির আহ্বান, ঈদুল আজহার শিক্ষা আমরা ধারণ করতে পারছি না ছিটেফোঁটাও। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। আমাদের সমাজে ঈদ আসে, আসে না কাঙ্ক্ষিত আনন্দ। ঈদের দিন গরিব-দুঃখী মানুষের দুর্ভোগ নতুন করে বাড়ে, বলার কিছু নেই। একটি ব্যাগ হাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে, কোরবানি দাতার ধমক খেয়ে, লাঠির বাড়ি সয়ে, দৌড়ানির পর দুই টুকরা হাড় জুটে অভাগা গরিবের কপালে। হায় কোরবানি! তুমি বুঝি এতই নিষ্ঠুর! ভালো গোস্ত মালিকের ফ্রিজে আর আত্মীয়ের বাড়ি পার হয়ে যায় খুব সহজে। আমাদের কপালে জুটে তোমার হাড়গুলো। কখনো যদি কোরবানির পশুটিকে কাছে পেত তবে এ কথাগুলোই বোধহয় জিজ্ঞেস করত ভাগ্যাহত বনি আদমেরা। হে মানুষ, আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, হ্যাঁ আপনাকেই। লাখ টাকার গরু কোরবানি করে ভাবছেন এ গরু আপনাকে পুলসিরাত পার করে দিবে, অথচ আপনি যে সব মাংস ফ্রিজে আর বেয়াইয়ের বাড়ি পার করে দিয়েছেন, নিরন্ন গরিবকে বঞ্চিত করেছেন, পাশের বাসার কোরবানি না করা পরিবারটিকে দুই টুকরো হাড় আর চর্বি দিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন; চোখ বন্ধ করে বলুন তো, আপনার কোরবানি কি ইব্রাহিম নবীর কোরবানির মতো হয়েছে? কিংবা আমাদের প্রিয় নবী যেমন কোরবানি দিয়েছেন, সাহাবিরা, আওলিয়ারা যেমন কোরবানি দিয়েছেন তেমন? না হয়নি। আমাদের নবীজী (সা.) বিদায় হজের দিন ১০০টি উট কোরবানি করেছেন। সবগুলোই উম্মতের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছেন। আর আমরা! একভাগ কোরবানি দিই, দিন শেষে হিসাব মিলাই জিত হলো না ঠক? হায়রে মুসলমান!  কবে ঘুম ভাঙবে তোমাদের? মনে রেখ! এ কোরবানি দিয়ে আর যাই হোক পুলসিরাত পার হওয়া যাবে না। শত শত নিরন্ন বনি আদমকে অভুক্ত রেখে সমাজের চোখে ধূলি দিতে পারবে তুমি, কিন্তু আল্লাহকে ফাঁকি দিবে কীভাবে? তিনি তো সব  দেখছেন। গোস্ত চাইতে আসা গরিবের সঙ্গে তোমার রুঢ় ব্যবহার, কোরবানি না করা গরিব প্রতিবেশীর প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি—এ সব কিন্তু তোমার কোরবানির কবুলিয়াতকে নষ্ট করে দিবে। তাই সাবধান হও। নিজেকে সংযত কর। বিলিয়ে দাও উজাড় করে প্রভুর তরে। আমাদের সমাজে আবার ফিরে আসুক কোরবানির প্রকৃত আমেজ, ত্যাগের উৎসব, মুছে যাক ধনী-গরিবের বৈষম্য। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঈদুল আজহার শিক্ষায়, ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কুরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

No comments