ব্রুস ক্যাম্পবেলের বিমানবাড়ি। ছবি: এয়ারপ্লেনহোম।মানুষের
মন বিচিত্র। বিচিত্র তার সব কাজ। বসতবাড়ির কথাই ধরুন, অদ্ভুত সব
নির্মাণশৈলী দিয়ে মানুষ গড়ে তোলে তার থাকার ঘর। সত্তর দশকের বিখ্যাত
কার্টুন ‘ফ্লিন্টস্টোন’-এ পাথরের এক বাড়ির আদলে পর্তুগালে ফাফে পাহাড়ের
ঢালে বিশাল দুটি পাথরখণ্ড দিয়ে ঘর বানিয়েছিলেন আলবার্তো ফিগুয়েইরা। এখন
সেটা পর্যটনকেন্দ্র। আবার, ক্যালিফোর্নিয়ার গ্যাবারভিলে কার্টুন চরিত্র
‘উডি উড পেকার’-এর আদলে রেড উড গাছের গুঁড়ির মধ্যে বাড়ি বানিয়েছেন এক
লোক।
জুল ভার্নের কল্পকাহিনি ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি’ বইয়ের
নায়ক ক্যাপ্টেন নিমোর নটিলাস ডুবোজাহাজকে মনে আছে? মেক্সিকোয় সেই
ডুবোজাহাজের আদলে অতিকায় শামুকের মতো বাড়ি বানিয়েছেন স্থাপত্যবিদ
হ্যাভিয়ের সেনসোয়ান। আছে জুতোর মতো বাড়িও। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের
পেনসিলভানিয়ার হেলমে। কেটলি, টয়লেট, এমনকি মহাকাশযানের আদলেও বাড়ি বানিয়েছে
মানুষ। তাহলে উড়োজাহাজ আর বাদ কেন!
না, বাদ তো যায়ই-নি, উল্টো ২০০০
ডলার খরচায় একটি পুরোনো ‘বোয়িং ৭৭৭’ কিনে সেটায় আরও ২৮ হাজার ডলার
বিনিয়োগ করে ঘষে-মেজে বসবাসের উপযোগী করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপিতে
জোয়ান ওসারি নামের এক ভদ্রমহিলা। আজ এমন এক বিমানবাড়ির গল্পই শুনুন:
বসবাসের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই রয়েছে ক্যাম্পবেলের বিমানবাড়িতে। ছবি: রয়টার্সযুক্তরাষ্ট্রের
ওরেগন রাজ্যের পাহাড়ঘেরা জাতীয় উদ্যানে পড়ে আছে একটা অতিকায় বিমান। ঘন
পাইনবনের মধ্যে সেই বিমানকে ওপর থেকে দেখলে মনে হবে, হয়তো দুর্ঘটনার শিকার
হয়ে এখন তা পরিত্যক্ত। কিন্তু ‘বোয়িং ৭২৭’ মডেলের সেই বিমানটির কাছে গেলে
বুঝতে পারবেন, ওটা আসলে বসতবাড়ি। লোকটির নাম ব্রুস ক্যাম্পবেল, পেশায়
ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। তিনিই বানিয়েছেন এ বিমান বাড়ি।
ব্যবহারের
অনুপযোগী হয়ে পড়া বিমানকে অবাঞ্ছিত জঞ্জালে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করার
ব্রত নিয়েছিলেন ক্যাম্পবেল। সেটা ১৯৯৯ সালের কথা। একপর্যায়ে ক্যাম্পবেলের এ
‘ব্রত’ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জীবনের লক্ষ্য। যদিও শুরুতে বিমান বাড়ি বানানোর
পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। মালগাড়িতে বাড়ি বানাতে চেয়েছিলেন ক্যাম্পবেল। একদিন
শুনলেন, মিসিসিপিতে এক নাপিত বিমানবাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন। ব্যস,
ক্যাম্পবেলের পরিকল্পনাও হুট করে বদলে গেল।
১৯৯৯ সালে ১ লাখ ডলার খরচায়
এথেন্স বিমানবন্দর থেকে একটি তিন ইঞ্জিনের বাণিজ্যিক একটি যাত্রীবাহী
‘বোয়িং ৭২৭’ বিমান কিনেছিলেন ক্যাম্পবেল। বিমানটি রাখতে ২৩ হাজার ডলার
খরচায় ১০ একর জায়গাও কেনেন তিনি।
বিমানের মধ্যে ক্যাম্পবেলের টয়লেট। ছবি: রয়টার্সক্যাম্পবেল
শুরুতে চেয়েছিলেন খেটেখুটে বিমানটি ঠিক করে ফেলবেন। কিন্তু সেই নাপিতের
গল্প শোনার পর বদলে যায় তাঁর কাজের ধরন। বিমানটিতে বাড়ির আদল দিতে কাজ
শুরু করেন ক্যাম্পবেল। প্রথমে দুটি ডানা খুলে ফেলেন। এরপর ‘ল্যান্ডিং
গিয়ার’-এর নিচে বসান কাঠের শক্ত থাম। তারপর পাখা দুটি আবার লাগান; তবে এবার
এমনভাবে যেন বিমানের ভারসাম্য ঠিক থাকে, কোনোদিকে কাত হয়ে না যায়।
টানা
কয়েক বছরের খাটুনি আর ২ লাখ ২০ হাজার ডলার খরচ করে অবশেষে বিমানটিকে বাড়ির
আদল দিতে সক্ষম হন ক্যাম্পবেল। বিচিত্র এ বাড়িটি বানানোর সময়
ক্যাম্পবেলের রাত কেটেছে মালগাড়িতে। সেটা এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে তাঁর
বিমানের পাশে। মালগাড়িতে ভীষণ ইঁদুরের উৎপাত ছিল। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে একদিন
বিমানে উঠে পড়েন ক্যাম্পবেল। বিমানটি তখনো থাকার উপযোগী হয়ে না উঠলেও
তারপর থেকে আর অন্য কোথাও থাকেননি ক্যাম্পবেল। এখন অবশ্য দিব্যি আছেন।
ঘুম থেকে ওঠার পর। ছবি: রয়টার্সতবে
ক্যাম্পবেলের এই বিমান বাড়িটির ভেতরটা ভীষণ অভিজাত ভাবলে ভুল করবেন।
সাধারণ জীবনযাপনই তাঁর পছন্দ। বিমানের মধ্যে মাদুর পেতে ঘুমান। আছে
গোসলখানা আর দুটি টয়লেট। পাইলটদের ‘ককপিট’ ব্যবহার করছেন বিনোদন কিংবা
পড়াশোনার জন্য। রসুইঘর বলতে মাইক্রোয়েভ কিংবা টোস্টার। টিনজাত এবং
শস্যজাত খাবারই বেশি খান। সিঁড়ি দিয়ে বিমানে ওঠার পর ঢোকার পথেই চোখে
পড়বে প্রমাণ সাইজের জুতো রাখার একটি তাক। সেখানে বাহারী সব
স্যান্ডেল-স্লিপার। সবই দর্শনার্থীদের জন্য। বিমানের ভেতরে কিংবা বাইরে
খালি পায়ে ঘুরে কেউ যেন সুচালো কোনো কিছুতে আঘাত না পায়, সে জন্যই এই
ব্যবস্থা।
ককপিটের মধ্যে খানিক অবসরে ক্যাম্পবেল। ছবি: রয়টার্সবিমানকে
বাড়ি হিসেবে ব্যবহার জনপ্রিয় করতে ক্যাম্পবেল একটি ওয়েবসাইট বানিয়েছেন।
সেখানে বিমান বাড়ি বানানোর সব ধরনের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন ক্যাম্পবেল।
নিজের এই বিচিত্র বাসস্থান নিয়ে ক্যাম্পবেলের ব্যাখ্যা, ‘এই ছোট্ট
বাসস্থানটুকু দিয়ে মানুষের স্বভাব বদলানোর চেষ্টা করেছি। আমার মতে,
পৃথিবীর সব মানুষই কিছু ব্যাপারে মনে মনে পাগল। এখানে মজা পাওয়াটাই আসল।’
বিমান বাড়ির প্রাকৃতিক শোভাও অনেক সুন্দর। ছবি: রয়টার্সক্যাম্পবেলের
মতো মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে বেশ কম। টেক্সাস থেকে নেদারল্যান্ডস পর্যন্ত
তাঁর মতো এমন কয়েকজন আছেন, যাঁরা পরিত্যক্ত বিমানকে ব্যবহার করছেন
বাসাবাড়ি হিসেবে। কিন্তু ৬৪ বছর বয়সী ক্যাম্পবেল একটি জায়গায় ব্যতিক্রম। এই
বুড়ো বয়সে তিনি ‘বোয়িং ৭৪৭’ মডেলের বিমান কিনে জাপানে যাওয়ার পরিকল্পনা
ফেঁদেছেন। জীবনের একটা সময় কাটিয়েছিলেন সেই ‘সূর্যোদয়ের দেশ’-এ,
ক্যাম্পবেল আবার সেখানে গিয়ে থাকতে চান, নতুন করে আরও একটি বিমান বাড়ি
বানিয়ে! সূত্র: রয়টার্স, বিজনেস ইনসাইডার।
No comments