Breaking News

গোয়েন্দা কাহিনী : খুনি ছিল ঘরেই

মির্জা মেহেদী তমাল
খুনি ছিল ঘরেই
‘হ্যালো, কে বলছেন? হ্যাঁ, আমার ছেলে বাপ্পী। কেন ভাই? কী ব্যাপার! আমার ছেলে তো এখন বাসাতেই’— অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোনকলে জবাব দিচ্ছিলেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আলফু মিয়া।
অপর প্রান্ত থেকে কিছু একটা শুনেই আলফু মিয়া ভয় পান। কাঁপা গলায় বলেন, ‘কী বলেন ভাই। আমার ছেলে আপনাদের কব্জায় মানে? ভাই, ও-ভাই, আমার একমাত্র আদরের লাল (বাবা যে নামে ডাকতেন)। ওর কিছু হলে আমি বাঁচব না। দেব ভাই। টাকা দেব। একটু সময় দেন। ২০ লাখ টাকার পুরাটা পাইবেন। ভাই, পোলাডারে ফেরত দেন। ’— এতটুকু বলতেই লাইন কেটে যায়। সেই নাম্বারে ফোন করেও আর খোলা পাওয়া যায় না। বাপ্পীকে আর জীবিত অবস্থায় ফেরত পাননি আলফু মিয়া। ২০ লাখ মুক্তিপণের টাকা সময়মতো না পেয়ে মানুষরূপী হায়েনার দল আট বছরের ফুটফুটে শিশুকে গলা টিপে হত্যা করে। নদীতে ঘোরানোর কথা বলে বাপ্পীকে নৌকায় তুলে নিয়েছিল ঘাতকরা। নৌকায় দুলতে দুলতে একসময় ঘাতকদের কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে শিশু বাপ্পী। এ সুযোগটিই কাজে লাগায় ঘাতকরা। ঘুমে থাকা বাপ্পীকে গলাটিপে হত্যা করে। এর পর তারা লাশ শীতলক্ষ্যার মাঝ নদীতে ছুড়ে ফেলে দেয়। দিনের পর দিন তল্লাশি চালিয়েও খুঁজে পাওয়া যায়নি বাপ্পীর লাশ। একপর্যায়ে খুনের ১০ দিনের মাথায় বাপ্পীর লাশ ভেসে ওঠে নারায়ণগঞ্জে। সারা দেশে তোলপাড় করা বাপ্পী অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটে আজ থেকে ১৫ বছর আগে পুরান ঢাকার বেচারাম দেউরি রোডে। ৫ আগস্ট অপহরণের তিন দিন পর ঘাতকরা ধরা পড়লে পুরো ঘটনা ফাঁস হয়। সারা দেশের মানুষ আঁতকে ওঠে ঘাতকদের নির্মমতায়। আরমানিটোলা স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির মেধাবী ছাত্র বাপ্পী ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান। ১০ দিন পর বাপ্পীর লাশ ভেসে ওঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে। ডেটলাইন ৫ আগস্ট : বাপ্পীকে অপহরণ করা হয়েছে— ফোনে এমন খবর শুনে আলফু মিয়া নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত বেরিয়ে পড়েন। কোতোয়ালির এক নং বেচারাম দেউরির বাসায় ঢুকেই এ ঘর ও ঘর ছোটাছুটি করেন। চিৎকার করে ছেলেকে ডাকতে থাকেন। ‘লাল, ও লাল! আমার লাল কই?’ স্ত্রী রোকসানা বেগম বলেন, ‘কেন ও তো মাঠে খেলতেছে। ’ আলফু মিয়া মাঠে ছোটেন। পেছন পেছন রোকসানা বেগম। তারা বাপ্পীর বন্ধুদের জিজ্ঞাস করে। না, আসেনি বাপ্পী খেলতে— জানায় বাপ্পীর বন্ধুরা। এবার আলফু মিয়া যেন চোখে অন্ধকার দেখছেন। হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। তবে কি, সত্যি সত্যি অপহরণ করেছে তার কলিজার টুকরাকে! ভাবছেন আলফু মিয়া। স্ত্রীকে সেই ফোন কলের কথা জানায়। স্ত্রী রোকসানা পুলিশকে জানাতে বলে। কিন্তু আলফু মিয়া ভয় পান। অপহরণকারীরা তাকে পুলিশকে খবর দিতে নিষেধ করেছে। পুলিশ জানতে পারলে বাপ্পীকে আর ফেরত পাবে না বলে হুমকি দিয়েছে। দিশাহারা আলফু মিয়া কী করবেন, বুঝতে পারেন না। তার ভায়রার ছেলে শিপনকে ফোন দেন আলফু মিয়া। বলেন, ‘শিপন, বাবা তুমি কোথায়? বাপ্পীর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। তুমি আসো বাবা। ’ এমন খবর শুনেই ছুটে আসে শিপন। শিপন এসে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন, ‘বাপ্পীরে কারা নিল খালু! হায় হায়। ’ শিপনকে খুব পছন্দ করত বাপ্পী। শিপন বলতে থাকে, ‘আজকে আমারে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে খাওয়ালো বাপ্পী। ’ এসব কথা বলেই আবার সান্ত্বনা দেন শিপন। ছেলেকে ফেরত পেতে পাগলপ্রায় আলফু মিয়া ২০ লাখ টাকা জোগাড় করে অপেক্ষায় থাকেন। তিনি বার বার পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করেন, আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখেন। পরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলেও তিনি কেটে দিচ্ছেন। সন্ধ্যা ৭টায় অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। দ্রুত রিসিভ করেই হ্যালো বলেন আলফু মিয়া। অপরপ্রান্ত থেকে যা বলা হচ্ছে, তিনি তা কলম দিয়ে টুকে নিচ্ছেন। বলছেন, ‘ঠিক আছে ভাই। পুরো টাকা রেডি আছে। আমি একাই আসব রাত ৮টার মধ্যে। না না ভাই, কেউ জানবে না। পুলিশকে বলব না ভাই। রাত ৮টার মধ্যে আমি ডেমরার ছনপাড়া বস্তির সামনে এসে দাঁড়াব টাকা নিয়ে। ভাই আমার পোলাডা ভালো আছে তো?’ অপরপ্রান্ত থেকে কোনো জবাব পায় না। লাইন কেটে যায়। টাকা নিয়ে ছুটে চলেন আলফু মিয়া। যেভাবেই হোক রাত ৮টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু পথে জ্যামে আটকে যান তিনি। গাড়ি আর এগোয় না। গাড়ি থেকে নেমে যান। দৌড়াতে থাকেন। আরেকটা গাড়িতে চড়েন। ছুটতে থাকেন। কিন্তু রাত ৮টার মধ্যে পৌঁছাতে পারেননি আলফু মিয়া। রাত ৯টায় সেখানে পৌঁছে অপহরণকারী কারও দেখা পান না। সন্ধান পান না তার সন্তানের। বাসায় ফেরত যান। পুলিশের শরণাপন্ন হন। পুলিশের অভিযান শুরু হয়। পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হানা দেয় পুলিশ। তিন দিন পর গ্রেফতার হয় অপহরণকারী ঘাতক চক্র। এর পরের গল্প নির্মমতার।   ডেমরা থেকে গ্রেফতার করা হয় ঘাতক চক্রের সদস্য শংকরকে। শংকরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে পুলিশ কিছুটা হোঁচট খায়। অপহরণের পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। পুলিশের কাছে স্বীকার করে কীভাবে বাপ্পীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। কার পরিকল্পনায় খুনের ঘটনা ঘটে সেটিও ফাঁস করে শংকর। পুলিশ পুরো ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আলফু মিয়াকে পুলিশ জানায় পুরো ঘটনাটি। পুলিশ জানায়, তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ এবং বাপ্পীর পছন্দের খালাতো ভাই শিপন হলো এ অপহরণ ও খুনের নেপথ্য কারিগর। তার নেতৃত্বেই অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা শুনে হতবাক পরিবারের সদস্যরা। পুলিশ খোঁজ করতে থাকে শিপনসহ খুনে জড়িত তাদের বন্ধু রিপন ও জাহিদকে। তারা পুলিশের কাছে খুনের বর্ণনা করেন। তারা পুলিশকে জানায়, ২০ লাখ টাকা নিয়ে ডেমরায় যেতে বলা হয় আলফু মিয়াকে। আলফু মিয়ার দেরি হওয়াতে তাদের সন্দেহ হচ্ছিল যে, পুলিশকে জানানো হয়েছে। পুলিশ জানতে পারলে শিপনের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাবে। যে কারণে তড়িঘড়ি করে বাপ্পীকে হত্যা করা হয়। ঘাতক শংকরের ভাষায়, ‘নদীতে ঘোরানোর কথা বলে শিপন তার খালাতো ভাই বাপ্পীকে নৌকায় তুলে নেয়। বাপ্পীর সঙ্গে শিপনের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। বাপ্পী একটু পর পর শিপন ভাইয়া শিপন ভাইয়া বলে বিভিন্ন প্রশ্ন রাখত। জানতে চাইত। নৌকায় তোলার পর চানাচুর আর বিস্কুট খাওয়ানো হয়। শিপনের কোলে মাথা রাখতে খুব ভালো লাগছিল বাপ্পীর। তাই কোলে মাথা রেখেই আকাশ দেখছিল। তখন রাত ১২টা হবে। এক সময় বাপ্পী ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত বাপ্পীর চেহারা দেখে আমাদের মায়া হচ্ছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাকে খুন করব না। কিন্তু শিপন তাতে রাজি হয়নি। ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে বলে খুনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এক সময় শিপন গলা চেপে ধরে, আর আমি দুই পা চেপে ধরি। বাপ্পীর শরীর থেকে কাপড় খুলে শীতলক্ষ্যা নদীর কাটপট্টি এলাকায় ছুড়ে ফেলে দিই। এরপরই আমরা দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি। ’ শিপন পুলিশকে জানায়, ‘৫ আগস্ট বেলা ১১টায় স্কুল থেকে বাপ্পী ফিরে বাসায়। এরপর আমি তাকে সাইকেলে ঘোরানোর কথা বলে বাইরে নিয়ে যাই। আবার ওদের বাসায় দিয়ে আসি। দুপুরে আবারও যাই বাপ্পীদের বাসায়। ওকে নিয়ে আবারও বাইরে যাই। কিছুক্ষণ ঘুরে আবারও বাসায় দিয়ে আসি। বিকালে আবারও ওদের বাসায় গিয়ে শেষবারের মতো বাপ্পীকে ফুটবল খেলার কথা বলে বাইরে নিয়ে আসি। শেষবার অবশ্য কেউ দেখেনি। বাপ্পীকে সোজা নিয়ে যাই যাত্রাবাড়ীর আমার বন্ধু সঞ্জীবের বাসায়। সেখানে সঞ্জীবকে বলি, ওর দিকে খেয়াল রাখতে। দাবা খেলতে। আমি বাপ্পীকে বলে আসি, তুই দাবা খেল, আমি আসতেছি। বাপ্পী বলছিল, তাড়াতাড়ি এসো ভাইয়া। ’ শিপন জানায়, ‘এরপর সন্ধ্যা ৭টায় তারা ডগাইর এলাকার একটি ফোন ফ্যাক্স দোকান থেকে ফোন করে আলফু মিয়ার কাছে। ২০ লাখ টাকা নিয়ে আসতে বলে। টাকা আনতে দেরি করায় খুনের পরিকল্পনা করি। ’ অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরের মধ্যেই ঘাপটি মেরে ছিল খুনি। আপন খালাতো ভাইকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করার মতো ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। অপহরণের পর পর পুলিশকে খবর দেওয়া গেলে হয়তো বাপ্পীকে প্রাণেও রক্ষা করা যেত। দ্রুততার সঙ্গে পুলিশ যেভাবে খুনি চক্রকে গ্রেফতার করেছে, একইভাবে বাপ্পীকেও উদ্ধার করা যেত।

No comments