আওয়ামী লীগের কেন আরো এক দফা ক্ষমতায় থাকা উচিত
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমাকে এক ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু সম্প্রতি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কটা কী?’ তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করেছি এ কথা কেন জানতে চাইছেন? তিনি বললেন, ‘আমি কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের পক্ষেই আপনি ৫০ বছর ধরে লেখালেখি করে আসছেন, জানি।
কিন্তু ঢাকায় দেখলাম, আওয়ামী লীগের বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতাই আপনার ওপর বিরক্ত। কেউ কটু কথা বলেননি; কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। ’ তাঁকে মজা করে জবাব দিয়েছি, দলের নেত্রী আমার ওপর সদয় থাকলে তাঁরা আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন, আমাকে খুশি করার চেষ্টা করেন। আর যদি জানতে পারেন নেত্রী আমার ওপর সদয় নন, তাহলে তাঁদের অনেকে আমাকে না চেনার, এড়িয়ে চলার ভান করেন। হয়তো নেত্রী আমার ওপর এখন সদয় নন, হয়তো আমার কৃষ্ণপক্ষ চলছে। ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধুও মজা করে বললেন, আপনার সাংবাদিকজীবনে আবার শুক্লপক্ষ কবে আসবে? আমি তাঁকে বলেছি, আমার সাংবাদিক-গুরু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বলতেন, কোনো সাংবাদিকেরই শুক্লপক্ষের আশা করে অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহপ্রাপ্তির আশা নিয়ে লেখালেখি করা উচিত নয়।
মানিক মিয়া এই নীতিটা মেনে চলতেন। তিনি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অন্ধ অনুসারী। তাঁর রাজনীতিকে সমর্থন দিয়ে তিনি সরকারি রোষে জেলেও গেছেন। কিন্তু এই সোহরাওয়ার্দী যখন ১৩ মাসের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তখন তাঁর সরকারের কোনো কোনো কাজের এমন সমালোচনা মানিক মিয়া ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে করেছেন, যা আমাদের বিস্মিত করেছে। মানিক মিয়ার কপাল ভালো, এ জন্য তাঁকে কখনো শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রোষে পড়তে হয়নি। মানিক মিয়া বলতেন, ‘শহীদ সাহেবকে আমি নেতা বলে মানি। তাঁকে ভুল পথে যেতে দেখলে আমি ছাড়া কে তাঁকে সতর্ক করার সাহস দেখাবে?
মানিক মিয়ার এ কথা থেকে এখনো প্রেরণা পাই। তিনি বলতেন, ‘আওয়ামী লীগকে আমি সমর্থন করি। কারণ পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দল দরকার। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ ও শাসন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী দল ও নেতৃত্ব চাই। দেশের বাম দলগুলো বহুধা বিভক্ত হয়ে কোনো দল রাশিয়ার, কোনো দল চীনের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দল নেই। তাই এই দলকে সমর্থন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই দলকে সব সময় আমি পছন্দ করি না। কারণ ক্ষমতায় গেলেই এই দলে সুবিধাবাদীরা এসে ভিড় জমায়। ’
বহুকাল আগে অগ্রজ সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এ কথা আমাদের বলেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরেও এ কথাগুলো আমার মনে গেঁথে আছে। ভারতের সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছি, এই মুহূর্তে হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা ছাড়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগেও এখন চরিত্রভ্রষ্ট নব্য ধনীদের ভিড়। নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ডানমুখী ও আপসপন্থী। তাই ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগকে পছন্দ করি না। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই দলকেই সমর্থন করতে হয়। ব্রিটেনের এক নামকরা সাংবাদিক চার্চিলকে দুই চোখে দেখতে পারতেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে সেই সাংবাদিকই অন্ধভাবে চার্চিলকে সমর্থন দান শুরু করেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদের হামলা থেকে ইউরোপ ও মানবতাকে রক্ষার জন্য চার্চিল ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিত্ব দেখছি না। ’
সাংবাদিক বন্ধু বললেন, এ জন্য চার্চিলের অনেক সমালোচকও এখন পর্যন্ত স্বীকার করেন, চার্চিল ব্রিটেনের ‘সেভিয়ার অব দ্য নেশন’। আমি শেখ হাসিনাকে কারো সঙ্গে তুলনা করছি না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তিনি সেভিয়ার অব দ্য নেশন। নানা ভুলভ্রান্তির জন্য তাঁর সমালোচনা করতে পারেন; কিন্তু তিনি যে নব্য ফ্যাসিবাদী ও হিংস্র মৌলবাদের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন এবং এখন পর্যন্ত রক্ষা করে চলেছেন—এ কথাটি স্বীকার করেন কি না!
তাঁকে বলেছি, শুধু স্বীকার করি না, এই একটি মাত্র কারণে তাঁকে এখনো বিনা দ্বিধায় সমর্থন করি। আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কী তার বিচার করি না। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বাংলাদেশে নব্য ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতির ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকে আশার আলো দেখিনি। দেশে নবীন-প্রবীণ বহু যোগ্য নেতা ছিলেন। বামপন্থী শিবিরের কথা বাদই দিলাম। আওয়ামী লীগে ড. কামাল হোসেনসহ বড় বড় নেতা তখনো ছিলেন। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় মওলানা ভাসানীর মতো গণমানুষের প্রবীণ নেতাও বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কেউ জিয়াউর রহমানের রক্তাক্ত ক্ষমতা দখলকে প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসার সাহস দেখাননি। ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনির মতো জিয়াউর রহমান বিনা বাধায় ক্ষমতা দখল করেছেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের কায়দায় একটি পুতুল পার্লামেন্ট গঠন করে তাকে বহুদলীয় গণতন্ত্র নাম দিয়েছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের মূলস্তম্ভগুলো একে একে ভাঙার ব্যবস্থা করেছেন।
বাংলাদেশে নব্য ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয় হিংস্র ধর্মীয় মৌলবাদ। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো ডলারের সাহায্যে এই মৌলবাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দিকে এগোয়। ঠিক এই সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আবির্ভাব। কৈশোর থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি তখন একজন স্ত্রী, মা ও গৃহিণী। দেশের এক বিপজ্জনক অবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। কিন্তু পিতার মতো অসীম সাহস দেখিয়ে তিনি এই নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরবে—এ কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।
ভারতের সাংবাদিক বন্ধু বললেন, অবশ্যই একজন সরকারপ্রধান হিসেবে তাঁর অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে; কিন্তু আমরা তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার একজন অনন্য নেত্রী হিসেবে দেখি তাঁর সাহস ও সেই সাহসের দ্বারা অর্জিত সাফল্যগুলোর জন্য। তাঁর জীবনের ওপর ছোট-বড় হামলা হয়েছে অন্তত সাত-আটবার। এর পরও তিনি ভয় পাননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড দিয়েছেন। এই একটি মাত্র কারণে তিনি ইতিহাসে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু যদি বাংলাদেশকে স্বাধীন করে থাকেন, তাহলে শেখ হাসিনা স্বাধীনতার কাঠামোটিকে অন্তত ঘরের ও বাইরের শত্রুর পৌনঃপুনিক হিংস্র ছোবল থেকে জীবনবাজি রেখে রক্ষা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী কর্নেল ফারুক বা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদদের বাংলার মাটিতে বিচার ও দণ্ড হবে—এ কথা কেউ ভাবার সাহসও পায়নি। এখন শেখ হাসিনা সম্পর্কে যে যা-ই বলুক, বাংলাদেশে ধর্মান্ধতার রাজনীতির বিষদাঁত তিনি ভেঙে দিয়েছেন। ভারতে বড় বড় নেতা ও বড় বড় গণতান্ত্রিক দল এই বিষদাঁত ভাঙতে পারেনি। ফলে ভারতের মতো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশেও উগ্র হিন্দুত্ববাদ ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা একাই সব চক্রান্তের মুখে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখল ঠেকিয়ে রেখেছেন, এটা কি তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য নয়? তাঁর এই সাফল্য স্থায়ী যাতে হয় সে জন্য তাঁর সরকারের আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকা উচিত।
আমিও এই চিন্তা-ভাবনা করছি ২০০৮ সালে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশটাকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ধর্মান্ধতার যে বেড়াজালে আটকে ফেলেছিল, তা থেকে দেশটাকে মুক্ত করার পর দীর্ঘকালের সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের জঞ্জালমুক্ত করার কাজে শেখ হাসিনার অন্তত তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকা উচিত। ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসে এ ধরনের কথা বলেছিলেন টোরি প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রিটেনের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে জঞ্জালমুক্ত করার জন্য আমাকে সময় দিতে হবে এবং তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে। ’ ব্রিটেনের মানুষ তাঁকে তিন টার্ম ক্ষমতায় রেখেছিল।
সাংবাদিক বন্ধুকে জানালাম, আমি কয়েক বছর আগে ভিয়েনায় অথবা জুরিখে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই এক সভায় তাঁর অন্তত তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলাম। তিনি দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে তাতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বাব্বা, তিন টার্ম!’ কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি দুই টার্ম ক্ষমতায় আছেন। সে জন্য দেশের অতুলনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে পেরেছেন। দেশে হিংস্র মৌলবাদের উত্থান ও ক্ষমতা দখল রুখে দিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য তাঁর অন্তত আরো এক দফা ক্ষমতায় থাকা উচিত। তাই আগামী সাধারণ নির্বাচনেও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় অবস্থান আমি প্রত্যাশা করি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের বিরুদ্ধে আমাদের তথাকথিত সুধীসমাজ যা-ই বলুক, এই নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটু খর্ব হয়েছে হয়তো; কিন্তু বাংলাদেশ আফগানিস্তানে পরিণত হওয়ার ভয়াবহ আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেয়েছে।
শুধু এই ভারতীয় সাংবাদিক নন, লন্ডনে বসেও বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে খবর রাখেন এমন কোনো কোনো বিদেশি সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, তাঁরাও মনে করেন, উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এক বিস্ময়কর ব্যতিক্রম, পাকিস্তানে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা শক্তিশালী হয়ে ওঠায় গৃহযুদ্ধ চলছে। মুসলমানদের হাতে মুসলমান নিহত হচ্ছে, মসজিদ-মাদরাসা ধ্বংস হচ্ছে। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ ক্ষমতা দখল করেছে। একমাত্র বাংলাদেশে এই ধর্মান্ধ ফ্যাসিবাদ সম্পূর্ণ নির্মূল করা না গেলেও তার উত্থান প্রতিহত করা গেছে। বাংলাদেশ যে তার অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন সত্তা এখনো নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে তার কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের এই অসাম্প্রদায়িক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই হাসিনা সরকারের আগামী নির্বাচনেও জয়ী হয়ে ক্ষমতায় থাকা উচিত।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আবির্ভাব না হলে পঁচাত্তরের ঘাতক ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড দেওয়া সম্ভব হতো না। আওয়ামী লীগ বিভক্ত হতো, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে থাকতে পারত না। সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন আরো দীর্ঘস্থায়ী হতো; বিএনপি-জামায়াতের শাসনে বাংলাদেশ আবার একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। তালেবান, আল-কায়েদার উত্থান প্রতিহত করা যেত না। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশও একটি কিলিং ফিল্ডে পরিণত হতো। আমেরিকা, ন্যাটো, এমনকি ভারত বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ পেত। গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসত না। অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটানো যেত না। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা কয়েকটি সমস্যার সমাধান হতো না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মান ও মর্যাদা বাড়ত না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি মডেল কান্ট্রি হিসেবে বিবেচিত হতো না। সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা যেত না।
শেখ হাসিনার সরকারের এ রকম অনেক সাফল্য তাঁর ব্যর্থতাগুলোকে ঢেকে ফেলেছে। এই সাফল্যগুলোকে স্থায়ী করা ও ধরে রাখার জন্যই এই সরকারের আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকা জরুরি। কথায় বলে, দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দুর্নীতি বাড়ে। আওয়ামী লীগ আরো এক টার্ম ক্ষমতায় থাকলে দুর্নীতির প্রকোপ একটু বাড়তে পারে। কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা যদি রক্ষা পায় এবং বর্তমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, সবার ওপরে উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যদি বজায় থাকে, তাহলে দুর্নীতি একটু-আধটু বাড়ল কি কমল তাতে ক্ষতি নেই।
ব্রিটিশ ক্যাপিটালিজম ও ব্রিটিশ এম্পায়ার তো গড়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির যথেচ্ছ লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে। বাংলাদেশে তেমন দুর্নীতি ও লুটপাট আমরা কেউ চাই না। না চাইলে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের শাসন অনেক উত্তম। বাংলাদেশে এখন নব্য পুঁজিবাদের দাপট চলছে। আওয়ামী লীগও তাতে প্রভাবান্বিত। কিন্তু এই মুহূর্তে এই দাপট নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল নেই। এ জন্য আওয়ামী লীগকে যতই অপছন্দ করি, দেশের শাসন ক্ষমতায় তার আরো এক দফা অবস্থান সমর্থন করি।
আমাকে এক ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধু সম্প্রতি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কটা কী?’ তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করেছি এ কথা কেন জানতে চাইছেন? তিনি বললেন, ‘আমি কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের পক্ষেই আপনি ৫০ বছর ধরে লেখালেখি করে আসছেন, জানি।
কিন্তু ঢাকায় দেখলাম, আওয়ামী লীগের বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতাই আপনার ওপর বিরক্ত। কেউ কটু কথা বলেননি; কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। ’ তাঁকে মজা করে জবাব দিয়েছি, দলের নেত্রী আমার ওপর সদয় থাকলে তাঁরা আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন, আমাকে খুশি করার চেষ্টা করেন। আর যদি জানতে পারেন নেত্রী আমার ওপর সদয় নন, তাহলে তাঁদের অনেকে আমাকে না চেনার, এড়িয়ে চলার ভান করেন। হয়তো নেত্রী আমার ওপর এখন সদয় নন, হয়তো আমার কৃষ্ণপক্ষ চলছে। ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধুও মজা করে বললেন, আপনার সাংবাদিকজীবনে আবার শুক্লপক্ষ কবে আসবে? আমি তাঁকে বলেছি, আমার সাংবাদিক-গুরু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বলতেন, কোনো সাংবাদিকেরই শুক্লপক্ষের আশা করে অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহপ্রাপ্তির আশা নিয়ে লেখালেখি করা উচিত নয়।
মানিক মিয়া এই নীতিটা মেনে চলতেন। তিনি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অন্ধ অনুসারী। তাঁর রাজনীতিকে সমর্থন দিয়ে তিনি সরকারি রোষে জেলেও গেছেন। কিন্তু এই সোহরাওয়ার্দী যখন ১৩ মাসের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন তখন তাঁর সরকারের কোনো কোনো কাজের এমন সমালোচনা মানিক মিয়া ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে করেছেন, যা আমাদের বিস্মিত করেছে। মানিক মিয়ার কপাল ভালো, এ জন্য তাঁকে কখনো শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রোষে পড়তে হয়নি। মানিক মিয়া বলতেন, ‘শহীদ সাহেবকে আমি নেতা বলে মানি। তাঁকে ভুল পথে যেতে দেখলে আমি ছাড়া কে তাঁকে সতর্ক করার সাহস দেখাবে?
মানিক মিয়ার এ কথা থেকে এখনো প্রেরণা পাই। তিনি বলতেন, ‘আওয়ামী লীগকে আমি সমর্থন করি। কারণ পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দল দরকার। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ ও শাসন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী দল ও নেতৃত্ব চাই। দেশের বাম দলগুলো বহুধা বিভক্ত হয়ে কোনো দল রাশিয়ার, কোনো দল চীনের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো দল নেই। তাই এই দলকে সমর্থন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই দলকে সব সময় আমি পছন্দ করি না। কারণ ক্ষমতায় গেলেই এই দলে সুবিধাবাদীরা এসে ভিড় জমায়। ’
বহুকাল আগে অগ্রজ সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এ কথা আমাদের বলেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরেও এ কথাগুলো আমার মনে গেঁথে আছে। ভারতের সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছি, এই মুহূর্তে হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা ছাড়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগেও এখন চরিত্রভ্রষ্ট নব্য ধনীদের ভিড়। নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ডানমুখী ও আপসপন্থী। তাই ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগকে পছন্দ করি না। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই দলকেই সমর্থন করতে হয়। ব্রিটেনের এক নামকরা সাংবাদিক চার্চিলকে দুই চোখে দেখতে পারতেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে সেই সাংবাদিকই অন্ধভাবে চার্চিলকে সমর্থন দান শুরু করেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদের হামলা থেকে ইউরোপ ও মানবতাকে রক্ষার জন্য চার্চিল ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিত্ব দেখছি না। ’
সাংবাদিক বন্ধু বললেন, এ জন্য চার্চিলের অনেক সমালোচকও এখন পর্যন্ত স্বীকার করেন, চার্চিল ব্রিটেনের ‘সেভিয়ার অব দ্য নেশন’। আমি শেখ হাসিনাকে কারো সঙ্গে তুলনা করছি না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তিনি সেভিয়ার অব দ্য নেশন। নানা ভুলভ্রান্তির জন্য তাঁর সমালোচনা করতে পারেন; কিন্তু তিনি যে নব্য ফ্যাসিবাদী ও হিংস্র মৌলবাদের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন এবং এখন পর্যন্ত রক্ষা করে চলেছেন—এ কথাটি স্বীকার করেন কি না!
তাঁকে বলেছি, শুধু স্বীকার করি না, এই একটি মাত্র কারণে তাঁকে এখনো বিনা দ্বিধায় সমর্থন করি। আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কী তার বিচার করি না। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বাংলাদেশে নব্য ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতির ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকে আশার আলো দেখিনি। দেশে নবীন-প্রবীণ বহু যোগ্য নেতা ছিলেন। বামপন্থী শিবিরের কথা বাদই দিলাম। আওয়ামী লীগে ড. কামাল হোসেনসহ বড় বড় নেতা তখনো ছিলেন। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় মওলানা ভাসানীর মতো গণমানুষের প্রবীণ নেতাও বেঁচে ছিলেন। কিন্তু কেউ জিয়াউর রহমানের রক্তাক্ত ক্ষমতা দখলকে প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসার সাহস দেখাননি। ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনির মতো জিয়াউর রহমান বিনা বাধায় ক্ষমতা দখল করেছেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের কায়দায় একটি পুতুল পার্লামেন্ট গঠন করে তাকে বহুদলীয় গণতন্ত্র নাম দিয়েছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের মূলস্তম্ভগুলো একে একে ভাঙার ব্যবস্থা করেছেন।
বাংলাদেশে নব্য ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয় হিংস্র ধর্মীয় মৌলবাদ। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো ডলারের সাহায্যে এই মৌলবাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দিকে এগোয়। ঠিক এই সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আবির্ভাব। কৈশোর থেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি তখন একজন স্ত্রী, মা ও গৃহিণী। দেশের এক বিপজ্জনক অবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। কিন্তু পিতার মতো অসীম সাহস দেখিয়ে তিনি এই নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরবে—এ কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।
ভারতের সাংবাদিক বন্ধু বললেন, অবশ্যই একজন সরকারপ্রধান হিসেবে তাঁর অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে; কিন্তু আমরা তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার একজন অনন্য নেত্রী হিসেবে দেখি তাঁর সাহস ও সেই সাহসের দ্বারা অর্জিত সাফল্যগুলোর জন্য। তাঁর জীবনের ওপর ছোট-বড় হামলা হয়েছে অন্তত সাত-আটবার। এর পরও তিনি ভয় পাননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড দিয়েছেন। এই একটি মাত্র কারণে তিনি ইতিহাসে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু যদি বাংলাদেশকে স্বাধীন করে থাকেন, তাহলে শেখ হাসিনা স্বাধীনতার কাঠামোটিকে অন্তত ঘরের ও বাইরের শত্রুর পৌনঃপুনিক হিংস্র ছোবল থেকে জীবনবাজি রেখে রক্ষা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী কর্নেল ফারুক বা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদদের বাংলার মাটিতে বিচার ও দণ্ড হবে—এ কথা কেউ ভাবার সাহসও পায়নি। এখন শেখ হাসিনা সম্পর্কে যে যা-ই বলুক, বাংলাদেশে ধর্মান্ধতার রাজনীতির বিষদাঁত তিনি ভেঙে দিয়েছেন। ভারতে বড় বড় নেতা ও বড় বড় গণতান্ত্রিক দল এই বিষদাঁত ভাঙতে পারেনি। ফলে ভারতের মতো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশেও উগ্র হিন্দুত্ববাদ ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা একাই সব চক্রান্তের মুখে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতা দখল ঠেকিয়ে রেখেছেন, এটা কি তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য নয়? তাঁর এই সাফল্য স্থায়ী যাতে হয় সে জন্য তাঁর সরকারের আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকা উচিত।
আমিও এই চিন্তা-ভাবনা করছি ২০০৮ সালে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশটাকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ধর্মান্ধতার যে বেড়াজালে আটকে ফেলেছিল, তা থেকে দেশটাকে মুক্ত করার পর দীর্ঘকালের সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের জঞ্জালমুক্ত করার কাজে শেখ হাসিনার অন্তত তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকা উচিত। ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এসে এ ধরনের কথা বলেছিলেন টোরি প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রিটেনের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে জঞ্জালমুক্ত করার জন্য আমাকে সময় দিতে হবে এবং তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে। ’ ব্রিটেনের মানুষ তাঁকে তিন টার্ম ক্ষমতায় রেখেছিল।
সাংবাদিক বন্ধুকে জানালাম, আমি কয়েক বছর আগে ভিয়েনায় অথবা জুরিখে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই এক সভায় তাঁর অন্তত তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলাম। তিনি দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে তাতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বাব্বা, তিন টার্ম!’ কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি দুই টার্ম ক্ষমতায় আছেন। সে জন্য দেশের অতুলনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে পেরেছেন। দেশে হিংস্র মৌলবাদের উত্থান ও ক্ষমতা দখল রুখে দিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য তাঁর অন্তত আরো এক দফা ক্ষমতায় থাকা উচিত। তাই আগামী সাধারণ নির্বাচনেও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় অবস্থান আমি প্রত্যাশা করি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের বিরুদ্ধে আমাদের তথাকথিত সুধীসমাজ যা-ই বলুক, এই নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটু খর্ব হয়েছে হয়তো; কিন্তু বাংলাদেশ আফগানিস্তানে পরিণত হওয়ার ভয়াবহ আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেয়েছে।
শুধু এই ভারতীয় সাংবাদিক নন, লন্ডনে বসেও বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে খবর রাখেন এমন কোনো কোনো বিদেশি সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি, তাঁরাও মনে করেন, উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এক বিস্ময়কর ব্যতিক্রম, পাকিস্তানে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা শক্তিশালী হয়ে ওঠায় গৃহযুদ্ধ চলছে। মুসলমানদের হাতে মুসলমান নিহত হচ্ছে, মসজিদ-মাদরাসা ধ্বংস হচ্ছে। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ ক্ষমতা দখল করেছে। একমাত্র বাংলাদেশে এই ধর্মান্ধ ফ্যাসিবাদ সম্পূর্ণ নির্মূল করা না গেলেও তার উত্থান প্রতিহত করা গেছে। বাংলাদেশ যে তার অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন সত্তা এখনো নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে তার কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের এই অসাম্প্রদায়িক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই হাসিনা সরকারের আগামী নির্বাচনেও জয়ী হয়ে ক্ষমতায় থাকা উচিত।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আবির্ভাব না হলে পঁচাত্তরের ঘাতক ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড দেওয়া সম্ভব হতো না। আওয়ামী লীগ বিভক্ত হতো, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে থাকতে পারত না। সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন আরো দীর্ঘস্থায়ী হতো; বিএনপি-জামায়াতের শাসনে বাংলাদেশ আবার একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হতো। তালেবান, আল-কায়েদার উত্থান প্রতিহত করা যেত না। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশও একটি কিলিং ফিল্ডে পরিণত হতো। আমেরিকা, ন্যাটো, এমনকি ভারত বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে সামরিক হস্তক্ষেপের সুযোগ পেত। গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসত না। অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটানো যেত না। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা কয়েকটি সমস্যার সমাধান হতো না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মান ও মর্যাদা বাড়ত না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি মডেল কান্ট্রি হিসেবে বিবেচিত হতো না। সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা যেত না।
শেখ হাসিনার সরকারের এ রকম অনেক সাফল্য তাঁর ব্যর্থতাগুলোকে ঢেকে ফেলেছে। এই সাফল্যগুলোকে স্থায়ী করা ও ধরে রাখার জন্যই এই সরকারের আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকা জরুরি। কথায় বলে, দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দুর্নীতি বাড়ে। আওয়ামী লীগ আরো এক টার্ম ক্ষমতায় থাকলে দুর্নীতির প্রকোপ একটু বাড়তে পারে। কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা যদি রক্ষা পায় এবং বর্তমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে, সবার ওপরে উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যদি বজায় থাকে, তাহলে দুর্নীতি একটু-আধটু বাড়ল কি কমল তাতে ক্ষতি নেই।
ব্রিটিশ ক্যাপিটালিজম ও ব্রিটিশ এম্পায়ার তো গড়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির যথেচ্ছ লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে। বাংলাদেশে তেমন দুর্নীতি ও লুটপাট আমরা কেউ চাই না। না চাইলে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের শাসন অনেক উত্তম। বাংলাদেশে এখন নব্য পুঁজিবাদের দাপট চলছে। আওয়ামী লীগও তাতে প্রভাবান্বিত। কিন্তু এই মুহূর্তে এই দাপট নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল নেই। এ জন্য আওয়ামী লীগকে যতই অপছন্দ করি, দেশের শাসন ক্ষমতায় তার আরো এক দফা অবস্থান সমর্থন করি।
No comments