প্রধানমন্ত্রী, আপনি এখনো একা; ‘বজ্র’দের ডাকুন
পীর হাবিবুর রহমান
সেদিন রবিবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের একটি আলোচনা সভায় গিয়েছিলাম। বাঙালি জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রশ্নে আমার আনুগত্য নিঃশর্ত।
জন্মের পর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার বীরত্বের গল্পই শুনিনি, হূদয়ে লালন করেছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পথে তার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নেমে আসা অন্ধকার সময়ে অগ্রজের হাত ধরে তার আদর্শ বুকে লালন করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে পথ হেঁটেছি। সেই ছাত্ররাজনীতি থেকে পেশাগত জীবনের এ পরিণত বয়সে এসেও আমি তাকে গভীরভাবে পাঠ করি। পাঠ করতে করতে এখনো রোমাঞ্চিত হই, অভিভূত হই, মুগ্ধ হই এবং গর্ববোধ করি। এ মহান নেতাকে হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই দিতে দিতে আমার আত্মাজুড়ে লালন করি। আমি সব সময় বলি, আমার নেতার নাম বঙ্গবন্ধু, দলের নাম মানুষ। হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, ষড়যন্ত্র, সংঘাতময় রাজদুর্নীতির এ যুগে কোনো দলের প্রতি আমার আনুগত্য নেই। কিন্তু আমিও স্বপ্ন দেখি, গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধিকার, স্বাধীনতার পথ ধরে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেই স্বপ্ন হলো— একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের, একটি মানবিক রাষ্ট্রের মানবিক রাজনীতির।
মানব কল্যাণের নিরাবরণ, সাদামাটা জীবনের আত্মত্যাগের রাজনীতিই ছিল তার দীক্ষা। সেই রাজনীতি ও স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট কাল রাতে পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একদল উচ্ছৃঙ্খল, বিপথগামী সেনা সদস্য হত্যা করেছিল। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, এমনকি শিশু সন্তানদেরও রেহাই দেয়নি।
কাদের সিদ্দিকীর আলোচনা সভায় অনেক বিলম্বে আমি পৌঁছি। তখন অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা ড. কামাল হোসেন কথা বলছিলেন। ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য শেষ হতেই সবাই চলে যাবেন, কিন্তু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) সবাইকে থাকার অনুরোধ জানিয়ে আমাকে কথা বলার যখন সুযোগ করে দেন, লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তার প্রতি গভীর ভালোবাসায় কিছু কথা বলেছি। কিন্তু ওখানে বসে ভাবছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ধানমন্ডির রক্তাক্ত বাসভবনে রাষ্ট্রের জনককে অনাদর-অবহেলায় ফেলে রেখে একদল ঘাতক যখন উল্লাস করতে করতে উচ্চাভিলাষী, বিশ্বাসঘাতক, মীরজাফর ও বঙ্গবন্ধুর পাঁচ শীর্ষ সহচরের একজন খন্দকার মোশতাককে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির আসনে বসাল তখন দলের অনেকের মধ্যে কেউ ভয়ে, কেউবা নির্ভয়ে লোভের পথে সেই সরকারে যোগ দিলেন। কেউবা একটি অসাংবিধানিক খুনি সরকারকে শপথবাক্য পাঠ করালেন, কেউবা খুনিদের মঞ্চে সেই শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন।
বাহিরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, রাজনীতিতে নিষিদ্ধ, সংখ্যালঘু, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি স্বস্তি ফেলল। মুজিববিদ্বেষী অতি বিপ্লবী ও উগ্রপন্থিরা অনেকেই তাদের কাতারে বন্দী হলেন। দেশজুড়ে একক আধিপত্য বিস্তারকারী বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ডুবল। প্রতিরোধের কোনো ডাক কেউ দিলেন না। কেউ কেউ খুনিদের সঙ্গে আপস না করে জেলখানায় জীবন দিলেন। কেউ কেউ কঠিন নির্যাতনের মুখে পতিত হয়ে কারাদহন নিলেন। তিন বাহিনীর প্রধানরা খুনিদের কাছে অবনত মস্তকে আনুগত্যই প্রকাশ করেননি; ইতিহাসের বলদের মতো শপথ অনুষ্ঠান ও বেতার ভাষণ উপভোগ করলেন। অনেক সিনিয়র সামরিক অফিসার রাষ্ট্রনায়কের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে তো পারেননি, তারাও খুনিদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হলেন।
লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ হলো। শুধু তাই নয়, খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা-পূর্ব সব শাসকেরা। যারা বলেন বঙ্গবন্ধুর জানাজায় লোক হয়নি তারা ইতিহাসের নির্মম সত্যকে অস্বীকার করেন। মৃত মুজিবকে সেদিন ক্ষমতাসীন খুনিচক্র এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, অস্ত্রের মুখে তার নিথর দেহ হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করেছে। কেউ কেউ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার মনোবাসনাও প্রকাশ করেছিলেন। তাদের পরিণতিও সুখের হয়নি, বিয়োগান্তক হয়েছে। ইতিহাস তাদের নিন্দিত করেছে। জনমন তাদের গ্লানিতে ডুবিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শের সন্তান ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম)। দেশের অভ্যন্তরে কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করে এ সুদর্শন তরুণ মুক্তিযুদ্ধে তার বাহিনী নিয়ে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধই পরিচালনা করেননি, নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাঘা সিদ্দিকী হিসেবে বীরত্বের খ্যাতি কুড়িয়েছেন। সেই কাদের সিদ্দিকী সেদিন পিতৃহত্যার সময় আওয়ামী লীগের কোনো দায়িত্বশীল নেতা ছিলেন না। জনপ্রতিনিধি হয়ে টাঙ্গাইলের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছেন মাত্র। তার হৃদয়, তার রক্ত প্রতিশোধের নেশায় পিতৃহত্যার প্রতিবাদে জেগে উঠল। ‘বঙ্গবন্ধুর আরেক সন্তান জীবিত’ বলেই তিনি আবারও প্রতিরোধ যুদ্ধের ডাক দিলেন।
জাতীয় মুক্তি বাহিনীর ব্যানারে সেদিন বঙ্গবন্ধুর ১৭ হাজার তরুণ কর্মী তার সঙ্গে যোগ দিলেন। দুই বছর যুদ্ধ করলেন। শতাধিক তরুণ শহীদ হলেন। এমনকি বিশ্বজিৎ নন্দীর মতো টগবগে তরুণ অতর্কিত হামলার মুখে যুদ্ধ করতে করতে গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে গেলেও ফাঁসির দণ্ড দিয়েছিল সামরিক আদালত। সেখান থেকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে সেনাশাসক এরশাদ মুক্তি দিয়েছিলেন। সেদিন কাদের সিদ্দিকীর ডাকে যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা সেসব নিন্দুকের মুখে চুনকালি লেপন করেছিলেন; যারা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কোনো প্রতিবাদ হয়নি। গোটা দেশ সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সামরিক বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ডাক আসলে জনগণ রাস্তায় নেমে আসত।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন হত্যাকাণ্ড কখনো ঘটেনি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী পিতা হারিয়ে বছরের পর বছর মাংস খেতে পারেননি। নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে তার আপন বড় বোনের মতোই হৃদয় দিয়ে লালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও বজ্রকে ছোট ভাইয়ের স্নেহ দিয়েছেন। অভিমানী ভাইয়ের আশ্রয়ের ঠিকানাই তিনি ছিলেন। এখনো তাদের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু মান-অভিমানের পালা যেন শেষ হয় না। মাঝে মাঝে তখনো মাথায় এসেছে, এখনো ভাবি, যে বীর যোদ্ধা জীবন বাজি রেখে পিতৃ হত্যার বদলা নিতে গিয়ে আওয়ামী লীগই নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী সব মানুষের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন; ভারতের রাজনীতিবিদরা যাকে বাঘা সিদ্দিকী বলে সম্মান করেছেন, ভালোবেসেছেন, এদেশের তরুণরা যাকে সেই যুদ্ধের সামরিক কায়দার পোশাক ও টুপি পরিহিত, শ্মশ্রুমণ্ডিত বীরকে নায়কের আসনে বসিয়েছিল। সেই তাকেই দেশে ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগ কেন সংগ্রাম করেনি?
তার স্ত্রী নাসরীন সিদ্দিকী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কমিটি করে আন্দোলন করেছেন। সেনাশাসন যুগের অবসান ঘটলে তিনি যেদিন দেশে ফিরেন বিমানবন্দরে লাখ লাখ মানুষের আবেগ উচ্ছ্বাসে আত্মহারা আনন্দে ঢল নামল। সেখানে তাকে অর্ভ্যথনা জানাতে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা কেন গেলেন না? সেদিন শুধু ফজলুর রহমান ও তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল গেলেন। আওয়ামী লীগের মান ইজ্জত রেখেছিলেন তারা। তার বেদনাহত নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে আত্মত্যাগের মহিমায় বীরের বেশে যিনি ফিরলেন তাকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কেন বরণ করতে বিমানবন্দরে যাননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচিতে যারা যোগ দিলেন তাদের কেউ কেউ মন্ত্রী হলেও কাদের সিদ্দিকীর ভাগ্যে মন্ত্রিত্ব দূরে থাক তার বাড়িতে পুলিশি অভিযান কেন হলো?
ভাবতে ভাবতে এর রহস্য আমি উন্মোচন করতে পারি না। একজন বীর নায়ককে দলের অনেক নেতা সেদিন ঈর্ষা করেছিলেন। তারাও আজ সুখে নেই। যন্ত্রণা ও গ্লানির জীবন ভোগ করছেন। সেদিন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বোনের সঙ্গে অভিমান করে বুকভাঙা কান্নায় মানুষকে কাঁদিয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে দল ছেড়ে ছিলেন। তাকে দলে রাখার উদ্যোগ কেউ নেননি। কেন এমনটি হলো আমি তার উত্তর পাই না। তিনি যখন তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কাছে সংবাদকর্মীদের নিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিচ্ছিলেন, তখন ১৫ আগস্টের মহাদুর্দিনে জার্মান রাষ্ট্রদূত হিসেবে গভীর মমতা ও সাহসিকতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দেওয়া সেদিনের স্পিকারের হাত পদত্যাগপত্র গ্রহণে কাঁপছিল। তার সামনে বসা তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বিব্রতবোধ করছিলেন। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পরে আমাকে বলেছিলেন, কাদের সিদ্দিকীর যত দোষ-ত্রুটিই থাক, ’৭১ ও ’৭৫-এর বীরত্বের কারণে সেসব এড়িয়ে আওয়ামী লীগের তাকে বুকে ধরে রাখাই উচিত ছিল। আমি এখনো আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সেই মন্তব্যটি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধিই করি না, বিশ্বাসও করি।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচনে তিনি যখন বিজয়ের পথে তখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ কেন তার বিজয় ঠেকাতে গেল? তাও বুঝি না। একটি আসন মুজিব-সন্তানকে দিয়ে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো? পিতৃহত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা যখন দল ছেড়ে কৃষক-শ্রমিক লীগের কাউন্সিল ডাকলেন, সেটি কাদের ইন্ধনে গুলিবর্ষণ করে পণ্ড করে দেওয়া হয়েছিল? এ হিসাব মাথায় আসে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খালকাটা বিপ্লবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টির যে নুহে আলম লেনিন ও আবদুল মান্নান খানরা উড়ে এসে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীই নন, প্রেসিডিয়াম সদস্য হন; সেখানে একজন বীরের, বার বার বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ প্রশ্নে, দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সাধকের মতো অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রতিবাদী প্রতিরোধ যোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর ঠাঁই হয় না, মন্ত্রিত্ব হয় না, প্রেসিডিয়ামে জায়গা হয় না? আজও আমি বুঝতে পারি না, একটি রাষ্ট্রের জনকের খুনিরা অসাংবিধানিকভাবে যেখানে ক্ষমতায়, সেখানে তাদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিতে অসুবিধা কোথায়?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার সব প্রশ্নের জবাব হয়তো আপনিই দিতে পারেন। একটি অসাংবিধানিক খুনি সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাসে গৌরবের দ্যুতি ছড়ায়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার কলঙ্ক বয়ে আনে না। সেই যুদ্ধে যাওয়া নায়ক কাদের সিদ্দিকীকে কেন আওয়ামী লীগে টেনে আনা যায় না? যারা মুজিব সরকার উত্খাত করতে চেয়েছিলেন, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও তার বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে চরম হটকারিতা, উগ্রতা দেখিয়েছেন, ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের চরিত্র হনন করেছেন, বঙ্গবন্ধু বললে চিৎকার করে উঠেছেন খুনিদের মতো কণ্ঠে শেখ মুজিব উচ্চারণ করতেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে যারা রাতভর বোমাসন্ত্রাসে নগরী কাঁপিয়েছিলেন তারা সবাই আজ বঙ্গবন্ধুর জিকির করতে করতে আওয়ামী লীগ সরকারের বেনিফিসিয়ারি হয়েছেন। কেউ ’৯৬ সাল থেকে কেউবা ২০০৮ সাল থেকে। কিন্তু যাদের অস্থিমজ্জায়, রক্তে, চিন্তায়, চেতনায় বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কিছু নেই, তারা কেন দলের বাইরে থাকবেন। তারা কেন অবহেলা অনাদরে পড়ে থাকবেন। যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন তাদের পরিবারের খবর কেন আওয়ামী লীগ সরকার রাখবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন ক্ষমতায় সেই দুঃসময়ের সংগঠন আর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের খবর কেন সরকার বা দল নেবে না, আমি তা বুঝি না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিই নীলকণ্ঠের মতো কত বঙ্গবন্ধু-বিদ্বেষী, আওয়ামী লীগবিরোধী ও দুঃসময়ের কৌশল গ্রহণকারী, চতুর মস্কোপন্থি, চীনাপন্থিদের সরকারে ঠাঁই দিলেন, দলে আশ্রয় দিলেন; নিজ ক্ষমতায় যারা এমপি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না তাদের এমপি-মন্ত্রী বানালেন, দলীয় পদ-পদবি দিলেন; সেখানে বার বার অস্ত্র হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে কেন কাছে টানছেন না? কিন্তু একটি কারণে আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যারা বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্বনন্দিত নেতাকে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল, তার চামড়া দিয়ে জুতা বানাতে চেয়েছিল, যারা তাকে উত্খাত করতে চেয়েছিল, যারা তার চামড়া দিয়ে ঢোল আর হাড্ডি দিয়ে ঢোল বাজাতে চেয়েছিল তাদের দিয়ে আপনি গর্বিত মুজিবকন্যা হিসেবে নিজের পায়ের জুতা পালিশ করাচ্ছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে বার বার বলেছেন আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি লাভের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সারা দেশে যে তারুণ্য মহান মুজিবের আদর্শ নিয়ে নতুন করে উজ্জীবিত ও জেগে উঠেছিলেন তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আজ কোথায়? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্বাসঘাতক, মীরজাফর খুনি মোশতাকের পথ নিয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছিল, তারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করেছে। যারা সেদিন নেতৃত্বদানে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যারা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খালাকাটা বিপ্লবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যোগ দিয়েছিলেন তারা সবাই আওয়ামী লীগ করছেন। এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন।
ছোট মানুষ হিসেবে আপনার কাছে আমার প্রশ্ন সেদিনের প্রতিরোধ যোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম কেন আওয়ামী লীগ করতে পারলেন না? অভিমানী ভাই, স্নেহময়ী বড় বোনের কাছে বড় বেশি আবদার হয়তো করে ফেলেছিলেন। দেশে আসার পরও ’৮২ সালে কল্যাণী ও বজ্র বলে আপনি তাকে যে চিঠি লিখেছেন সেখানে বলেছেন, ‘জানি খুব রেগে আছো। মনে হয় দূর থেকেও তোমার রাগ দেখতে পাই। আমার সঙ্গে তো শুধু রাগ অভিমানই করলে, আবার এও জানি যত রাগই করো না কেন, আপার সামনে এলে সব রাগ পানি হয়ে যেতে বাধ্য। চিঠি দেই না দেখে এটা ভেবো না যে, মনে করি না। সব সময় মনে করি। খবরও যে পাই না তা নয়, খবরও পাই। তাছাড়া ঢাকায় অনেক ভিড়ের মাঝে আমি ভীষণ একা। ’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সময় অনেক বদলে গেছে, আজ সারা দেশে যতদূর চোখ যায়, শুধু আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। সুবিধাবাদী, মতলববাজ, বর্ণচোরা, তদবিরবাজ, একাত্তরের পরাজিত জামায়াতকর্মী, সেনাশাসক জিয়ার বিএনপির সঙ্গে জড়িত সবাই আজ আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার চারদিকে এত স্তাবক কোরাস করে, দেখলে ভয় লাগে। মনে হয় কেউ বঙ্গবন্ধুর সেই আত্মশুদ্ধির পথ নিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর নির্লোভ, নিরাবরণ, সাদামাটা ত্যাগের রাজনীতির সততার পথ থেকে দলকে অনেকদূর নিয়ে গেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত। এ রক্ত পরাভব মানে না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর রক্তে চতুরতা নেই। জেদ আছে, একগুঁয়েমি আছে, সরলতা আছে, মহান মুজিব ও আপনাদের জন্য অন্তরে ক্রন্দন আছে। সেই ক্রন্দন আছে বলেই, ১৫ আগস্ট জাতির বেদনাবিধুর শোকাবহ সন্ধ্যায় মিলাদ মাহফিল শেষে আপনি তাকে পরম স্নেহে ডেকে নেন। সেও তার পিতার টুঙ্গিপাড়ার কবরে গিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দুই হাত তুলে রাতভর হৃদয়ে আকুতিভরা মোনাজাত করেছেন। একুশের গ্রেনেড হামলার পর ঢাকায় ফিরেই সোজা আপনার কাছে ছুটে যান। আপনি শুধু একজন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বড় বোনই নন, অসংখ্য মুজিবভক্ত, দুঃসময়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের পরম আশ্রয়। আপনার প্রিয় বজ্রকে কাছে টানুন। বজ্রকে আপনার চেয়ে জীবিত কোনো রাজনীতিবিদ বা আওয়ামী লীগার বেশি চেনেন না, পড়তেও পারেন না। মান্নান খানরা মন্ত্রী হলে, জিয়ার খালকাটা বাম মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী, নেতা হলে, আপনার প্রিয় বজ্র কেন অভিমান-অনুরাগে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে? ওয়ান-ইলেভেনে বঙ্গবীর পালিয়ে যাননি, সেদিন আওয়ামী লীগে থাকলে আপনার কারাফটকের বাইরে সব প্রতিরোধ ভেঙে তিনি অবস্থান নিয়ে বলতেন, এ দেশ বঙ্গবন্ধুর নামে পিতার ডাকে যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছি, যমুনার পানিতে ভেসে আসিনি। আমার বোনের মুক্তি চাই। বোকাসোকা দীর্ঘদেহী কাদের সিদ্দিকী বুকভরা দহন ও ভালোবাসা রাখে বলেই দ্রোহ করতে পারে, অভিমান করতে পারে; বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়াতে পারে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়েছেন। সুশাসন নিশ্চিত করুন। সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে দলের নেতা-কর্মীদের আদর্শিক রাজনীতির পথে ফিরিয়ে এনে সুসংগঠিত করুন। বঙ্গবন্ধু ও আপনি আজীবন মানুষের গণতন্ত্রের অধিকারের জন্য, ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ আপনার সামনে। সেই চ্যালেঞ্জ আপনি গ্রহণ করে সব রাজনৈতিক শক্তি ও মানুষকে আস্থায় আনুন। সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করুন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিরাপদ রাখুন। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী যেভাবে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের আজকের লড়াইয়ে রাজভিখেরিরাও একটি স্বাধীনচেতা বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে হটকারী, ভেংচি মাখানো অশ্লীল, অশ্রাব্য কথা বলে। তখন তা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এসব চাটুকার, মোসাহেব, আগুন্তুক কিংবা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতাদের থামান। আপনার সংগ্রাম, আপনার একার। আপনার সংগ্রাম, জনগণের সংগ্রাম। সুযোগ-সন্ধানী মতলববাজদের সংগ্রাম নয়। আপনার পাশে শেখ কামাল, শেখ জামাল নেই, আপনার আদরের রাসেল নেই। সুখে-দুঃখে সবেধন নীলমণি শেখ রেহানা রয়েছেন। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখবেন, আপনি সেই ’৮২-তে লেখা চিঠির ভাষার মতো এখনো একা, বড় বেশি একা। আপনার একটি ভাই বজ্র, যে একাত্তর ও ’৭৫-এর বীরত্বে বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসেবে বিশ্বনন্দিত হয়েছেন। দোহাই লাগে, তাকে কাছে টানুন। ’৭৫-এর পর বড় নেতারা বিভ্রান্ত করলেও মাঠের তৈরি কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি, আপনার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য রেখে পথ চলছে, দল করছে। তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করুন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সেদিন রবিবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের একটি আলোচনা সভায় গিয়েছিলাম। বাঙালি জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রশ্নে আমার আনুগত্য নিঃশর্ত।
জন্মের পর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার বীরত্বের গল্পই শুনিনি, হূদয়ে লালন করেছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পথে তার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নেমে আসা অন্ধকার সময়ে অগ্রজের হাত ধরে তার আদর্শ বুকে লালন করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে পথ হেঁটেছি। সেই ছাত্ররাজনীতি থেকে পেশাগত জীবনের এ পরিণত বয়সে এসেও আমি তাকে গভীরভাবে পাঠ করি। পাঠ করতে করতে এখনো রোমাঞ্চিত হই, অভিভূত হই, মুগ্ধ হই এবং গর্ববোধ করি। এ মহান নেতাকে হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই দিতে দিতে আমার আত্মাজুড়ে লালন করি। আমি সব সময় বলি, আমার নেতার নাম বঙ্গবন্ধু, দলের নাম মানুষ। হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, ষড়যন্ত্র, সংঘাতময় রাজদুর্নীতির এ যুগে কোনো দলের প্রতি আমার আনুগত্য নেই। কিন্তু আমিও স্বপ্ন দেখি, গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধিকার, স্বাধীনতার পথ ধরে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেই স্বপ্ন হলো— একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের, একটি মানবিক রাষ্ট্রের মানবিক রাজনীতির।
মানব কল্যাণের নিরাবরণ, সাদামাটা জীবনের আত্মত্যাগের রাজনীতিই ছিল তার দীক্ষা। সেই রাজনীতি ও স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট কাল রাতে পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একদল উচ্ছৃঙ্খল, বিপথগামী সেনা সদস্য হত্যা করেছিল। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, এমনকি শিশু সন্তানদেরও রেহাই দেয়নি।
কাদের সিদ্দিকীর আলোচনা সভায় অনেক বিলম্বে আমি পৌঁছি। তখন অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা ড. কামাল হোসেন কথা বলছিলেন। ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য শেষ হতেই সবাই চলে যাবেন, কিন্তু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) সবাইকে থাকার অনুরোধ জানিয়ে আমাকে কথা বলার যখন সুযোগ করে দেন, লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তার প্রতি গভীর ভালোবাসায় কিছু কথা বলেছি। কিন্তু ওখানে বসে ভাবছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ধানমন্ডির রক্তাক্ত বাসভবনে রাষ্ট্রের জনককে অনাদর-অবহেলায় ফেলে রেখে একদল ঘাতক যখন উল্লাস করতে করতে উচ্চাভিলাষী, বিশ্বাসঘাতক, মীরজাফর ও বঙ্গবন্ধুর পাঁচ শীর্ষ সহচরের একজন খন্দকার মোশতাককে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির আসনে বসাল তখন দলের অনেকের মধ্যে কেউ ভয়ে, কেউবা নির্ভয়ে লোভের পথে সেই সরকারে যোগ দিলেন। কেউবা একটি অসাংবিধানিক খুনি সরকারকে শপথবাক্য পাঠ করালেন, কেউবা খুনিদের মঞ্চে সেই শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন।
বাহিরে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত, রাজনীতিতে নিষিদ্ধ, সংখ্যালঘু, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি স্বস্তি ফেলল। মুজিববিদ্বেষী অতি বিপ্লবী ও উগ্রপন্থিরা অনেকেই তাদের কাতারে বন্দী হলেন। দেশজুড়ে একক আধিপত্য বিস্তারকারী বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ডুবল। প্রতিরোধের কোনো ডাক কেউ দিলেন না। কেউ কেউ খুনিদের সঙ্গে আপস না করে জেলখানায় জীবন দিলেন। কেউ কেউ কঠিন নির্যাতনের মুখে পতিত হয়ে কারাদহন নিলেন। তিন বাহিনীর প্রধানরা খুনিদের কাছে অবনত মস্তকে আনুগত্যই প্রকাশ করেননি; ইতিহাসের বলদের মতো শপথ অনুষ্ঠান ও বেতার ভাষণ উপভোগ করলেন। অনেক সিনিয়র সামরিক অফিসার রাষ্ট্রনায়কের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে তো পারেননি, তারাও খুনিদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হলেন।
লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ হলো। শুধু তাই নয়, খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা-পূর্ব সব শাসকেরা। যারা বলেন বঙ্গবন্ধুর জানাজায় লোক হয়নি তারা ইতিহাসের নির্মম সত্যকে অস্বীকার করেন। মৃত মুজিবকে সেদিন ক্ষমতাসীন খুনিচক্র এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, অস্ত্রের মুখে তার নিথর দেহ হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করেছে। কেউ কেউ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার মনোবাসনাও প্রকাশ করেছিলেন। তাদের পরিণতিও সুখের হয়নি, বিয়োগান্তক হয়েছে। ইতিহাস তাদের নিন্দিত করেছে। জনমন তাদের গ্লানিতে ডুবিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শের সন্তান ছিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম)। দেশের অভ্যন্তরে কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করে এ সুদর্শন তরুণ মুক্তিযুদ্ধে তার বাহিনী নিয়ে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধই পরিচালনা করেননি, নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাঘা সিদ্দিকী হিসেবে বীরত্বের খ্যাতি কুড়িয়েছেন। সেই কাদের সিদ্দিকী সেদিন পিতৃহত্যার সময় আওয়ামী লীগের কোনো দায়িত্বশীল নেতা ছিলেন না। জনপ্রতিনিধি হয়ে টাঙ্গাইলের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছেন মাত্র। তার হৃদয়, তার রক্ত প্রতিশোধের নেশায় পিতৃহত্যার প্রতিবাদে জেগে উঠল। ‘বঙ্গবন্ধুর আরেক সন্তান জীবিত’ বলেই তিনি আবারও প্রতিরোধ যুদ্ধের ডাক দিলেন।
জাতীয় মুক্তি বাহিনীর ব্যানারে সেদিন বঙ্গবন্ধুর ১৭ হাজার তরুণ কর্মী তার সঙ্গে যোগ দিলেন। দুই বছর যুদ্ধ করলেন। শতাধিক তরুণ শহীদ হলেন। এমনকি বিশ্বজিৎ নন্দীর মতো টগবগে তরুণ অতর্কিত হামলার মুখে যুদ্ধ করতে করতে গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে গেলেও ফাঁসির দণ্ড দিয়েছিল সামরিক আদালত। সেখান থেকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে সেনাশাসক এরশাদ মুক্তি দিয়েছিলেন। সেদিন কাদের সিদ্দিকীর ডাকে যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা সেসব নিন্দুকের মুখে চুনকালি লেপন করেছিলেন; যারা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কোনো প্রতিবাদ হয়নি। গোটা দেশ সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সামরিক বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ডাক আসলে জনগণ রাস্তায় নেমে আসত।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন হত্যাকাণ্ড কখনো ঘটেনি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী পিতা হারিয়ে বছরের পর বছর মাংস খেতে পারেননি। নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে তার আপন বড় বোনের মতোই হৃদয় দিয়ে লালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও বজ্রকে ছোট ভাইয়ের স্নেহ দিয়েছেন। অভিমানী ভাইয়ের আশ্রয়ের ঠিকানাই তিনি ছিলেন। এখনো তাদের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু মান-অভিমানের পালা যেন শেষ হয় না। মাঝে মাঝে তখনো মাথায় এসেছে, এখনো ভাবি, যে বীর যোদ্ধা জীবন বাজি রেখে পিতৃ হত্যার বদলা নিতে গিয়ে আওয়ামী লীগই নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী সব মানুষের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন; ভারতের রাজনীতিবিদরা যাকে বাঘা সিদ্দিকী বলে সম্মান করেছেন, ভালোবেসেছেন, এদেশের তরুণরা যাকে সেই যুদ্ধের সামরিক কায়দার পোশাক ও টুপি পরিহিত, শ্মশ্রুমণ্ডিত বীরকে নায়কের আসনে বসিয়েছিল। সেই তাকেই দেশে ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগ কেন সংগ্রাম করেনি?
তার স্ত্রী নাসরীন সিদ্দিকী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কমিটি করে আন্দোলন করেছেন। সেনাশাসন যুগের অবসান ঘটলে তিনি যেদিন দেশে ফিরেন বিমানবন্দরে লাখ লাখ মানুষের আবেগ উচ্ছ্বাসে আত্মহারা আনন্দে ঢল নামল। সেখানে তাকে অর্ভ্যথনা জানাতে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা কেন গেলেন না? সেদিন শুধু ফজলুর রহমান ও তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল গেলেন। আওয়ামী লীগের মান ইজ্জত রেখেছিলেন তারা। তার বেদনাহত নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে আত্মত্যাগের মহিমায় বীরের বেশে যিনি ফিরলেন তাকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কেন বরণ করতে বিমানবন্দরে যাননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচিতে যারা যোগ দিলেন তাদের কেউ কেউ মন্ত্রী হলেও কাদের সিদ্দিকীর ভাগ্যে মন্ত্রিত্ব দূরে থাক তার বাড়িতে পুলিশি অভিযান কেন হলো?
ভাবতে ভাবতে এর রহস্য আমি উন্মোচন করতে পারি না। একজন বীর নায়ককে দলের অনেক নেতা সেদিন ঈর্ষা করেছিলেন। তারাও আজ সুখে নেই। যন্ত্রণা ও গ্লানির জীবন ভোগ করছেন। সেদিন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বোনের সঙ্গে অভিমান করে বুকভাঙা কান্নায় মানুষকে কাঁদিয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে দল ছেড়ে ছিলেন। তাকে দলে রাখার উদ্যোগ কেউ নেননি। কেন এমনটি হলো আমি তার উত্তর পাই না। তিনি যখন তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কাছে সংবাদকর্মীদের নিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিচ্ছিলেন, তখন ১৫ আগস্টের মহাদুর্দিনে জার্মান রাষ্ট্রদূত হিসেবে গভীর মমতা ও সাহসিকতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দেওয়া সেদিনের স্পিকারের হাত পদত্যাগপত্র গ্রহণে কাঁপছিল। তার সামনে বসা তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বিব্রতবোধ করছিলেন। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পরে আমাকে বলেছিলেন, কাদের সিদ্দিকীর যত দোষ-ত্রুটিই থাক, ’৭১ ও ’৭৫-এর বীরত্বের কারণে সেসব এড়িয়ে আওয়ামী লীগের তাকে বুকে ধরে রাখাই উচিত ছিল। আমি এখনো আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সেই মন্তব্যটি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধিই করি না, বিশ্বাসও করি।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচনে তিনি যখন বিজয়ের পথে তখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ কেন তার বিজয় ঠেকাতে গেল? তাও বুঝি না। একটি আসন মুজিব-সন্তানকে দিয়ে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো? পিতৃহত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা যখন দল ছেড়ে কৃষক-শ্রমিক লীগের কাউন্সিল ডাকলেন, সেটি কাদের ইন্ধনে গুলিবর্ষণ করে পণ্ড করে দেওয়া হয়েছিল? এ হিসাব মাথায় আসে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খালকাটা বিপ্লবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টির যে নুহে আলম লেনিন ও আবদুল মান্নান খানরা উড়ে এসে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীই নন, প্রেসিডিয়াম সদস্য হন; সেখানে একজন বীরের, বার বার বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ প্রশ্নে, দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সাধকের মতো অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রতিবাদী প্রতিরোধ যোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর ঠাঁই হয় না, মন্ত্রিত্ব হয় না, প্রেসিডিয়ামে জায়গা হয় না? আজও আমি বুঝতে পারি না, একটি রাষ্ট্রের জনকের খুনিরা অসাংবিধানিকভাবে যেখানে ক্ষমতায়, সেখানে তাদের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিতে অসুবিধা কোথায়?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার সব প্রশ্নের জবাব হয়তো আপনিই দিতে পারেন। একটি অসাংবিধানিক খুনি সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাসে গৌরবের দ্যুতি ছড়ায়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার কলঙ্ক বয়ে আনে না। সেই যুদ্ধে যাওয়া নায়ক কাদের সিদ্দিকীকে কেন আওয়ামী লীগে টেনে আনা যায় না? যারা মুজিব সরকার উত্খাত করতে চেয়েছিলেন, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও তার বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে চরম হটকারিতা, উগ্রতা দেখিয়েছেন, ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের চরিত্র হনন করেছেন, বঙ্গবন্ধু বললে চিৎকার করে উঠেছেন খুনিদের মতো কণ্ঠে শেখ মুজিব উচ্চারণ করতেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে যারা রাতভর বোমাসন্ত্রাসে নগরী কাঁপিয়েছিলেন তারা সবাই আজ বঙ্গবন্ধুর জিকির করতে করতে আওয়ামী লীগ সরকারের বেনিফিসিয়ারি হয়েছেন। কেউ ’৯৬ সাল থেকে কেউবা ২০০৮ সাল থেকে। কিন্তু যাদের অস্থিমজ্জায়, রক্তে, চিন্তায়, চেতনায় বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কিছু নেই, তারা কেন দলের বাইরে থাকবেন। তারা কেন অবহেলা অনাদরে পড়ে থাকবেন। যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন তাদের পরিবারের খবর কেন আওয়ামী লীগ সরকার রাখবে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন ক্ষমতায় সেই দুঃসময়ের সংগঠন আর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের খবর কেন সরকার বা দল নেবে না, আমি তা বুঝি না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিই নীলকণ্ঠের মতো কত বঙ্গবন্ধু-বিদ্বেষী, আওয়ামী লীগবিরোধী ও দুঃসময়ের কৌশল গ্রহণকারী, চতুর মস্কোপন্থি, চীনাপন্থিদের সরকারে ঠাঁই দিলেন, দলে আশ্রয় দিলেন; নিজ ক্ষমতায় যারা এমপি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না তাদের এমপি-মন্ত্রী বানালেন, দলীয় পদ-পদবি দিলেন; সেখানে বার বার অস্ত্র হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে কেন কাছে টানছেন না? কিন্তু একটি কারণে আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যারা বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্বনন্দিত নেতাকে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল, তার চামড়া দিয়ে জুতা বানাতে চেয়েছিল, যারা তাকে উত্খাত করতে চেয়েছিল, যারা তার চামড়া দিয়ে ঢোল আর হাড্ডি দিয়ে ঢোল বাজাতে চেয়েছিল তাদের দিয়ে আপনি গর্বিত মুজিবকন্যা হিসেবে নিজের পায়ের জুতা পালিশ করাচ্ছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে বার বার বলেছেন আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি লাভের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সারা দেশে যে তারুণ্য মহান মুজিবের আদর্শ নিয়ে নতুন করে উজ্জীবিত ও জেগে উঠেছিলেন তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আজ কোথায়? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্বাসঘাতক, মীরজাফর খুনি মোশতাকের পথ নিয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেছিল, তারা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ করেছে। যারা সেদিন নেতৃত্বদানে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যারা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের খালাকাটা বিপ্লবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যোগ দিয়েছিলেন তারা সবাই আওয়ামী লীগ করছেন। এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন।
ছোট মানুষ হিসেবে আপনার কাছে আমার প্রশ্ন সেদিনের প্রতিরোধ যোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম কেন আওয়ামী লীগ করতে পারলেন না? অভিমানী ভাই, স্নেহময়ী বড় বোনের কাছে বড় বেশি আবদার হয়তো করে ফেলেছিলেন। দেশে আসার পরও ’৮২ সালে কল্যাণী ও বজ্র বলে আপনি তাকে যে চিঠি লিখেছেন সেখানে বলেছেন, ‘জানি খুব রেগে আছো। মনে হয় দূর থেকেও তোমার রাগ দেখতে পাই। আমার সঙ্গে তো শুধু রাগ অভিমানই করলে, আবার এও জানি যত রাগই করো না কেন, আপার সামনে এলে সব রাগ পানি হয়ে যেতে বাধ্য। চিঠি দেই না দেখে এটা ভেবো না যে, মনে করি না। সব সময় মনে করি। খবরও যে পাই না তা নয়, খবরও পাই। তাছাড়া ঢাকায় অনেক ভিড়ের মাঝে আমি ভীষণ একা। ’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সময় অনেক বদলে গেছে, আজ সারা দেশে যতদূর চোখ যায়, শুধু আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। সুবিধাবাদী, মতলববাজ, বর্ণচোরা, তদবিরবাজ, একাত্তরের পরাজিত জামায়াতকর্মী, সেনাশাসক জিয়ার বিএনপির সঙ্গে জড়িত সবাই আজ আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার চারদিকে এত স্তাবক কোরাস করে, দেখলে ভয় লাগে। মনে হয় কেউ বঙ্গবন্ধুর সেই আত্মশুদ্ধির পথ নিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর নির্লোভ, নিরাবরণ, সাদামাটা ত্যাগের রাজনীতির সততার পথ থেকে দলকে অনেকদূর নিয়ে গেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত। এ রক্ত পরাভব মানে না। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর রক্তে চতুরতা নেই। জেদ আছে, একগুঁয়েমি আছে, সরলতা আছে, মহান মুজিব ও আপনাদের জন্য অন্তরে ক্রন্দন আছে। সেই ক্রন্দন আছে বলেই, ১৫ আগস্ট জাতির বেদনাবিধুর শোকাবহ সন্ধ্যায় মিলাদ মাহফিল শেষে আপনি তাকে পরম স্নেহে ডেকে নেন। সেও তার পিতার টুঙ্গিপাড়ার কবরে গিয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দুই হাত তুলে রাতভর হৃদয়ে আকুতিভরা মোনাজাত করেছেন। একুশের গ্রেনেড হামলার পর ঢাকায় ফিরেই সোজা আপনার কাছে ছুটে যান। আপনি শুধু একজন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বড় বোনই নন, অসংখ্য মুজিবভক্ত, দুঃসময়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের পরম আশ্রয়। আপনার প্রিয় বজ্রকে কাছে টানুন। বজ্রকে আপনার চেয়ে জীবিত কোনো রাজনীতিবিদ বা আওয়ামী লীগার বেশি চেনেন না, পড়তেও পারেন না। মান্নান খানরা মন্ত্রী হলে, জিয়ার খালকাটা বাম মতিয়া চৌধুরী আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী, নেতা হলে, আপনার প্রিয় বজ্র কেন অভিমান-অনুরাগে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে? ওয়ান-ইলেভেনে বঙ্গবীর পালিয়ে যাননি, সেদিন আওয়ামী লীগে থাকলে আপনার কারাফটকের বাইরে সব প্রতিরোধ ভেঙে তিনি অবস্থান নিয়ে বলতেন, এ দেশ বঙ্গবন্ধুর নামে পিতার ডাকে যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছি, যমুনার পানিতে ভেসে আসিনি। আমার বোনের মুক্তি চাই। বোকাসোকা দীর্ঘদেহী কাদের সিদ্দিকী বুকভরা দহন ও ভালোবাসা রাখে বলেই দ্রোহ করতে পারে, অভিমান করতে পারে; বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়াতে পারে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়েছেন। সুশাসন নিশ্চিত করুন। সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে দলের নেতা-কর্মীদের আদর্শিক রাজনীতির পথে ফিরিয়ে এনে সুসংগঠিত করুন। বঙ্গবন্ধু ও আপনি আজীবন মানুষের গণতন্ত্রের অধিকারের জন্য, ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ আপনার সামনে। সেই চ্যালেঞ্জ আপনি গ্রহণ করে সব রাজনৈতিক শক্তি ও মানুষকে আস্থায় আনুন। সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করুন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিরাপদ রাখুন। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী যেভাবে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের আজকের লড়াইয়ে রাজভিখেরিরাও একটি স্বাধীনচেতা বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে হটকারী, ভেংচি মাখানো অশ্লীল, অশ্রাব্য কথা বলে। তখন তা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এসব চাটুকার, মোসাহেব, আগুন্তুক কিংবা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতাদের থামান। আপনার সংগ্রাম, আপনার একার। আপনার সংগ্রাম, জনগণের সংগ্রাম। সুযোগ-সন্ধানী মতলববাজদের সংগ্রাম নয়। আপনার পাশে শেখ কামাল, শেখ জামাল নেই, আপনার আদরের রাসেল নেই। সুখে-দুঃখে সবেধন নীলমণি শেখ রেহানা রয়েছেন। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখবেন, আপনি সেই ’৮২-তে লেখা চিঠির ভাষার মতো এখনো একা, বড় বেশি একা। আপনার একটি ভাই বজ্র, যে একাত্তর ও ’৭৫-এর বীরত্বে বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসেবে বিশ্বনন্দিত হয়েছেন। দোহাই লাগে, তাকে কাছে টানুন। ’৭৫-এর পর বড় নেতারা বিভ্রান্ত করলেও মাঠের তৈরি কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি, আপনার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য রেখে পথ চলছে, দল করছে। তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করুন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments