বরগুনা-১: মনোনয়ন দ্বন্দ্বে আ’লীগ : ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপি

আগে তালতলী এবং আমতলী নিয়ে আসনটি গঠিত হলেও পরে এতে জেলা সদরকে যুক্ত করা হয়। ফলে আগের ৩টি আসনের জায়গায় দুটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় জেলাবাসীকে। ২টি পৌরসভা এবং ২৪টি ইউনিয়ন নিয়ে এ নির্বাচনী এলাকায় ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ ৯২ হাজার ৫৮২।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ৫ বার, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী একবার, বিএনপি ১, জাতীয় পার্টি ২, জাসদ ১ বার করে জয়লাভ করেছে। বিএনপি মনে করছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে বিভিন্ন নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকার হরণের কারণে ভোটাররা আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
আর এই সুযোগটিই কাজে লাগাবে বিএনপি। তবে স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগকে হারাতে হলে বিএনপির মধ্যে ঐক্য জরুরি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রের প্রভাবশালী নেতা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে কঠিন দ্বন্দ্ব চলছে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের। এর সঙ্গে বিএনপির বহু নেতা মনোনয়ন চাচ্ছেন। এ নিয়ে লবিংয়ের ফলেও বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে।
আওয়ামী লীগে নবীন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বলছেন, ‘বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে এ পর্যন্ত ৫ বার মনোনয়ন দিয়েছে দল। এর মধ্যে ৪ বার জিতেছেন তিনি। একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনের কাছে হেরে যান। একবার উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার উচিত নতুনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়া।
আওয়ামী লীগে এবার যারা মনোনয়ন চাচ্ছেন তাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বরগুনা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর কবীর, বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি মো. দেলোয়ার হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জেলা যুবলীগ সভাপতি ও সাবেক জেলা ছাত্রলীগ নেতা অ্যাডভোকেট মো. কামরুল আহসান মহারাজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বরগুনা সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি গোলাম সরোয়ার টুকু, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বরগুনা সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি অ্যাডভোকেট শাহ মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ অলি, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গোলাম সরোয়ার ফোরকান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক মশিউর রহমান শিহাব এবং বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. আবদুল মোতালেব মিয়া।
বিএনপির মনোনয়ন প্রার্থীরা হলেন- সাবেক এমপি মতিউর রহমান তালুকদার, জেলা বিএনপির সভাপতি মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লা, কর্নেল (অব.) আবদুল খালেক, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহশ্রমবিষয়ক সম্পাদক ফিরোজ উজ জামান মামুন মোল্লা এবং জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এসএম নজরুল ইসলাম। জাতীয় পার্টির জেলা সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল লতিফ ফরাজি প্রার্থী হতে পারেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি যে এবার মনোনয়ন প্রশ্নে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়বেন তা বোঝা যায় ২১ সেপ্টেম্বর বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায়ই।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ এমপি আফম বাহাউদ্দিন নাছিমের উপস্থিতিতে ওই সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর কবীর, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. হুমায়ূন কবীর ও আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম দেলোয়ার হোসেন প্রকাশ্যে জেলা সভাপতি ও এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কথা হয় ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘বরগুনাকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বানানোসহ দৃশ্যমান ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করেছি। অসমাপ্ত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড শেষ করার জন্য আবারও দলের কাছে মনোনয়ন চাইব।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে বরগুনা-১ আসনে যত উন্নয়ন হয়েছে তার পেছনের ব্যক্তিটি আমি।
শতকরা ৭০ ভাগ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। হাসপাতাল, ক্লিনিক থেকে শুরু করে পলিটেকনিক্যাল কলেজ ও তালতলীকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় জেলা সভাপতির দায়িত্বে থাকায় নেতাকর্মীদের আপন করে দেখেছি।’ কথা হয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর কবীরের সঙ্গে।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘মনোনয়ন পরিবর্তন না হলে বরগুনার উন্নয়ন হবে না। দলের কাছে এমপিদের জবাবদিহিতা থাকা দরকার। কিন্তু এমপিরা তাদের উন্নয়নমূলক কাজ কোথায় কিভাবে করেন তা দল জানে না।’ মনোনয়ন প্রার্থী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘২০০১ সালে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বর্তমান এমপিকে হারিয়ে জয়লাভ করেছিলাম।
দীর্ঘ এক যুগ পর এ বছর দলের প্রার্থী হয়ে বরগুনা জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাইব। দিলে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পেয়ে জয়লাভ করব।’ অ্যাডভোকেট মো. কামরুল আহসান মহারাজ বলেন, ‘দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়করণ এখন সবার মুখে মুখে। আস্থা ফেরাতে প্রার্থী বদলের বিকল্প নেই।’
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আমি জেলা যুবলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় বর্তমান এমপি যুবলীগের একজন সহসভাপতি দিয়ে জেলাব্যাপী ভারপ্রাপ্ত যুবলীগের সভাপতি পরিচয়ে ব্যানার ফেস্টুন দিয়ে বিতর্কের জম্ম দিয়েছেন।
আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চাইব। এই ভয়ে আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন তিনি।’ ‘বরিশাল বিভাগে একসঙ্গে ১৭টি পৌরসভায় নির্বাচন হয়। শুধু আমিই পরাজিত হয়েছি’ উল্লেখ করে তিনি এ জন্য বর্তমান এমপিকে দায়ী করেন।
আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, ‘মানুষ পরিবর্তন প্রত্যাশা করছেন। সাধারণ মানুষ চায় তরুণ এবং নতুন নেতৃত্ব আসুক। আগামী নির্বাচনে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ নেতৃত্বে আসবেন। দীর্ঘদিন একক নেতৃত্বে মানুষ দিশেহারা। আমরা যারা মনোনয়ন চাইব, তারা সবাই নতুন নেতৃত্ব চাই। পরিবর্তন চাই নেতৃত্বের।’
দুই দফায় বরগুনা পৌর মেয়রের দায়িত্ব পালনকারী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান মিয়াও বৃহত্তর অঙ্গনে কাজ করতে আগ্রহী।
সম্ভাব্য প্রার্থী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ অলি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘অবশ্যই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাইব। পরে এ নিয়ে বিস্তারিত জানাব।’
২১ সেপ্টেম্বর বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতাদের সামনে সম্পাদকীয় রিপোর্ট পেশ করতে না পারার ক্ষোভের কথাও যুগান্তরকে বলেন তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গোলাম সরোয়ার ফোরকান বলেন, ‘আবারও মনোনয়ন চাইব। পেলে আমতলী ও তালতলী দুই উপজেলায় একচেটিয়া ভোট পাব।’
জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এসএম মশিউর রহমান শিহাব বলেন, ‘সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইলেও বরগুনায় তা দৃশ্যমান হয়নি। আমি মনোনয়ন পেলে জনগণের আশার প্রতিফলন ঘটাব।’
মনোনয়ন প্রশ্নে জেলা বিএনপির সাবেক এমপি মতিউর রহমান তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, ‘পায়রা নদীর পূর্বপারে আমতলী ও তালতলী উপজেলায় একক প্রার্থী আমি। মনোনয়ন পেলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। বরগুনা জেলা বিএনপির সভাপতি মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লা জানান, দলের কাছে মনোনয়ন চাইব।
মনোনয়ন চাইবেন তার আপন ভাতিজা মো. ফিরোজ উজ জামান মামুন মোল্লা। তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপির সহশ্রমবিষয়ক সম্পাদক।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘তরুণ নেতৃত্ব হিসেবে আসছেন তারেক রহমান। তরুণ হিসেবে দলের কাছে মনোনয়ন চাইব।’ জেলা বিএনপির আরেক নেতা কর্নেল (অব.) আবদুল খালেক বলেন, ‘আমি বরগুনা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলাম। সে সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল।
বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর কবীরকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছি। দল আমায় মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটে জয়লাভের ব্যাপারে আশাবাদী।’
No comments