মজলুমদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানের দাবি
ড. হাফেজ এ বি এম হিজবুল্লাহ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭,শুক্রবার, ০০:০০
এশিয়ার দণি-পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমার। উত্তরে চীন ও ভারত দেিণ বঙ্গোপসাগর ও থাইল্যান্ড, পূর্বে চীন ও লাওস এবং পশ্চিমে ভারত ও বাংলাদেশ। মিয়ানমারের দণি-পশ্চিমে আরাকানের অবস্থান।
আরাকান মিয়ানমারের (বার্মা) একটি অঙ্গরাজ্য। এটি বাংলাদেশের দণি ও দণি-পূর্বাংশে অবস্থিত এবং অতি প্রাচীনকাল থেকে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
আরাকানে ইসলাম ও রোহিঙ্গা মুসলমান : ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খলিফা হারুনুর রশিদের আমলে আরাকানে আরব বণিকদের মাধ্যমে ইসলামের আগমন হয়। মুসলমানদের
আচার-আচরণে সেখানকার জনগণ আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে সেখানে একটি ইসলামী রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং প্রথম মুসলমান শাসক হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন সুলতান সুলাইমান শাহ। এরপর প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর (১৪৩০-১৭৮৪) আটচল্লিশজন মুসলিম শাসক রাজ্যটি শাসন করেন। এ সময় আরাকানে প্রচুর মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘মাসজিদ বাদরুল মাকাম’ ও ১৪৩০ সনে নির্মিত ‘মাসজিদ সিন্দি খান’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও এ মুসলিম রাজ্যে নিজস্ব মুদ্রা চালু ছিল যার এক পিঠে কালিমা তায়্যিবা খচিত ছিল। এ রাজ্যে বসবাসকারী মুসলিম জনগণ পরবর্তীতে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ‘মুসলমান সংস্কৃতি আরাকানের জনগণের জীবন এবং আরাকানের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অনেক বাঙালি মুসলমান কবি আরাকান রাজসভায় অংশগ্রহণ করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কবি আশরাফ খান রাজা থাদোমেÍরের (১৬৪৫-৫২) সমযয় যুদ্ধমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। আশরাফ খান ‘উজির লস্কর’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন শক্তিশালী মন্ত্রী এবং তাঁর কৃতকর্মের জন্য রাজা তাঁকে একটি তলোয়ার ও কিছু হাতি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। আরাকান রাজসভায় মধ্যযুগের আরো দু’জন বিখ্যাত বাঙালি কবি তাদের প্রতিভার স্বার রাখেন। এরা হলেন দৌলতকাজী ও আলাওল।
ইসলামের সম্প্রসারণের আশঙ্কায় ১৭৮৪ সালে বোদাউপায়ার (১৭৮২-১৮১৯) সময়ে আরাকান রাজ্য বার্মা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয় এবং ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ শক্তি আরাকান দখলে নেয় এবং মুসলমানদের দুর্বল করা এবং প্রতিটি েেত্র বৌদ্ধদের শক্তিশালী করার ল্েয কাজ করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শক্তি বার্মাকে ব্রিটিশ ভারতের সাথে সংযুক্ত করে এবং প্রায় এক শ’ বছর এ ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৩৭ সনে ব্রিটিশরা বার্মাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রিটিশ বার্মা নামে আলাদা ঔপনিবেশিক রাজ্যে পরিণত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এটি সাময়িকভাবে জাপানের দখলে ছিল। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে।
আরাকানে মুসলিম নিধন ও মানবতাবিরোধী নির্যাতনের ইতিহাস
১৭৮৪ সালে বোদাউপায়ার (১৭৮২-১৮১৯) সময়ে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন ও নির্যাতনের ইতিহাস শুরু হয়। শুরু হয় সেখানে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন এবং প্রচুর মুসলমানকে রাজ্য ত্যাগে বাধ্য করা হয় এবং তাদের সহায়-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। হত্যা করা হয় আলিম ও দাঈদেরকে। ধ্বংস করা হয় মাসজিদ মাদরাসা। বৌদ্ধদের মুসলিমদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, তাদের সম্পদ লুটে নেয়া, মুসলমানদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালানোর অবাধ সুযোগ দেয়া হয়। মুসলমানদের বিনা পারিশ্রমিকে বিভিন্ন গৃহ নির্মাণ, বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ ও কৃষি কাজে বাধ্য করা হয়।
১৮২৪ সালে ব্রিটিশ শক্তি আরাকান দখলে নেয় এবং মুসলমানদের দুর্বল করা এবং প্রতিটি েেত্র বৌদ্ধদের শক্তিশালী করার ল্েয কাজ করে। কৌশল হিসেবে তারা আন্তঃধর্মীয় হিংসা ছড়িয়ে দেয়। এতে মুসলিম বৌদ্ধদের মাঝে ধর্মীয় সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের শক্তি দুর্বল করার ল্েয তারা কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়। যেমন : এক. সরকারি চাকরি থেকে মুসলমানদের অপসারণ করে তাদের স্থলে বৌদ্ধদের নিয়োগ দেয়। দুই. মুসলমানদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সেগুলো বৌদ্ধদের মাঝে বণ্টন করে। তিন. মুসলমানদের বিশেষ করে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে কারাবন্দী করা অথবা দেশান্তরিত করা হয়। চার. মসজিদ, মাদরাসা এবং ইসলামী বিচারালয় বন্ধ করে দেয় এবং বিস্ফোরক দিয়ে সেগুলো উড়িয়ে দেয় ইত্যাদি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান তিন বছর (১৯৪২-১৯৪৫) বার্মা দখলে রাখে। এ বছরটি ছিল মুসলমানদের জন্য ভয়ঙ্কর ও দুঃস্বপ্নের বছর। ২৭ জুন ১৯৪২ থেকে ৬ জুন ১৯৪২ পর্যন্ত নির্বিচারে চলে মুসলমানদের ওপর বর্বর আক্রমণ, নির্যাতন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা লাভের পর নতুন করে মুসলিম নির্মূল অভিযান শুরু হয়। বিশেষ করে ১৯৬২ সনে সামরিক জান্তার মতা দখলের পর প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে।
১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘নাগামান’ (ড্রাগন রাজা) অভিযানের ফলে প্রায় দুই লাখ (২০০,০০০) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সরকারিভাবে এই অভিযান ছিল প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যে সব বিদেশী অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই সেনা অভিযান সরাসরি বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছিল এবং ফলে ব্যাপক হত্যার ঘটনা ঘটে।
১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। ২০০৫ সালে জাতিসঙ্ঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
‘আরাকানি মুসলিম লেখকদের মতানুসারে প্রায় ১২ লাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বিভিন্ন সময় নির্যাতনের মুখে আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে ৫ লাখ, পাকিস্তানে ২ লাখ ৫০ হাজার, বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩০ হাজার, গালফ স্টেটগুলোয় ৫৫ হাজার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ৪৩ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ১০ হাজারেরও বেশি মুসলমান আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে।’ (আরাকানে মুসলমানদের ইতিহাস)।
এ পর্যায়ে আমাদের করণীয়
এক. বিতাড়িত ও নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইবোনেরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদেরও ভাইবোন। তাদের মানবেতর জীবন আমাদের কাঁদায়। এমতাবস্থায় আমাদের পে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কেননা কুরআন কারিমের ভাবানুবাদ অনুযায়ী ‘সব মুমিন ভাই ভাই’। হুজুরাত : ১০। অপর দিকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষ্য অনুযায়ী ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য প্রাচীরের মতো, এক অংশ অন্য অংশকে মজবুতভাবে আঁকড়ে থাকে’ (বুখারি : ৪৮১)। অপর এক হাদিসে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ঈমানদারের উদাহরণ হলো একটি দেহের মতো, যখন ব্যক্তি মাথার ব্যথায় পীড়িত হয় তখন পুরো দেহ আর্তনাদ করে ওঠে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৮৩৫৫)। এ ছাড়া আরো কুরআন কারিমের প্রচুর আয়াত ও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রচুর হাদিস রয়েছে যাতে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার নির্দেশ পাওয়া যায়। তাই আমাদের সাধ্য অনুযায়ী তাদের প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসতে পারি। খাদ্য, বস্ত্রসহ জীবন ধারণের অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করতে পারি। সাময়িক হলেও তাদের ঠাঁই দিতে পারি। এটা আমাদের ঈমানের দাবি।
দুই. তাদের এ পরিস্থিতির সুযোগে কেউ যেন তাদের ঈমান ও আকিদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। খ্রিষ্টান মিশনারি ও কাদিয়ানিরা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিরীহ মানুষকে সেবা দানের নামে তাদের ধর্মান্তরিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।
তিন. আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই দেয়া বা মেয়াদি অনুদান বা সহযোগিতা স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। শরণার্থী শিবির কোনো সমাধান নয়। এতে যেমন বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ হওয়ার সুযোগ হয়, তেমনি নানান বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হয়। তাই এর স্থায়ী সমাধানকল্পে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
চার. এ েেত্র মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে এর কোনো বিকল্প নেই। সব ধরনের মিডিয়ায় এর সংবাদ প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
পাঁচ. মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালনে নির্ভীকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পপাতমুক্ত সঠিক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করতে হবে এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে সমস্যা নিরসনে আসতে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
ছয়. বর্তমান সময়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত আরাকানে মানবতাবিরোধী যে আগ্রাসন চলছে তাকে কোনো সভ্য সমাজ সমর্থন করতে পারে না। তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া মানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন। আর এ আগ্রাসী কর্মযজ্ঞের ফলে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে তা মানবতার বিপর্যয় হিসেবে গণ্য। তাদের রাষ্ট্রহীন করে অন্য দেশে ঠেলে দেয়ার মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। বাংলাদেশ একার পে এ সমস্যা নিরসন সম্ভব বলে মনে হয় না। এ জন্য প্রয়োজনÑ
ক. মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চার করতে হবে প্রথমেই। কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমার সরকারকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন বন্ধে চাপ প্রয়োগ হতে হবে।
খ. প্রয়োজনে অর্থনৈতিক অবরোধ করা যেতে পারে ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা যেতে পারে।
গ. এটা বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। এটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সমস্যা। তাই সরকারকেও এ সমস্যা নিরসনে আন্তর্জাতিক শক্তি বলয়কে পাশে পাওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
No comments