Breaking News

ভীতির রাজনীতি

 ড. আবদুল লতিফ মাসুম

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট মোটাদাগে স্বাধীনতাকে দু’ভাবে চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, মানুষের মৌলিক চাহিদা থেকে স্বাধীনতা; দ্বিতীয়ত, ভীতি থেকে স্বাধীনতা। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে কংগ্রেসে প্রদত্ত বক্তৃৃতায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মানুষ শুধু খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচে না, তার স্বাচ্ছন্দ্যকর বাঁচার জন্য নিরাপদ পৃথিবী প্রয়োজন। মানুষের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়, যদি সে নিজের ইচ্ছে, নিজের বিবেক ও নিজের খুশিমতো আনন্দ উপভোগ করতে না পারে। যুদ্ধের ভীতি থেকে রুজভেল্ট পৃথিবীর সব মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি জয়ী হয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীর সাধারণ মানুষ কি সেই ভীতিমুক্ত পৃথিবী পেয়েছে?

স্বাধীনতার নামে পরে বিজয়ী মিত্রশক্তি গোটা পৃথিবীকে অধীন করে ফেলেছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় পৃথিবীর মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়, নাইন-ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিভীষিকার বেড়াজাল সৃষ্টি করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বে যেমন পরাশক্তিগুলো ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তেমনি তাদের অধস্তনরা নিজ নিজ দেশে ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে। একদল মানবতার মুক্তির নামে স্বাধীনতার বিপক্ষে লৌহপ্রাচীর নির্মাণ করেছে। সমাজতন্ত্রের নামে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সর্বহারার রাজত্বের পরিবর্তে সর্বভুকের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। মানুষের সতত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কৃত্রিম ভীতিতন্ত্র যে স্থায়ী হতে পারে না, তাসের ঘরের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের উবে যাওয়া তার বড় প্রমাণ। আরেক দল গণতন্ত্রের নামে ভীতিতন্ত্র কায়েম করেছে। পৃথিবীর সব স্বৈরাচার গণতন্ত্রের লেবাস গায়ে দেয়। মুখরোচক শব্দের আড়ালে তাদের সর্বাত্মক শাসন কায়েম করে। তা হয় কথিত মৌলিক গণতন্ত্র, সর্বহারার গণতন্ত্র, নির্দেশিত গণতন্ত্র, নয়া গণতন্ত্র অথবা শোষিতের গণতন্ত্র।
আরেক দল আছেন, তারা গণতন্ত্রের লেবাসেরও ধার ধারেন না। তারা এই একবিংশ শতাব্দীতেও নিজেদের রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ ও সুলতান-সম্রাট বলে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। তারা ফ্রান্সের চতুর্দশ লুইয়ের মতো মনে করেন- ‘আমিই রাষ্ট্র’। রাষ্ট্রের সব সহায়-স¤পত্তিকে তারা ব্যক্তিগত স¤পত্তি মনে করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাদের একটি বিশেষণ আছে। আর তা হলো- ’মহৎ স্বৈরতন্ত্র’। এ ক্ষেত্রে সামরিক খেতাবধারী স্বৈরতন্ত্র অনেক দূর এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী ’মগের মুল্লুক’ এর কথা বলা যেতে পারে। সেখানে অং সান সুচিরা নামেমাত্র রাজা রানী, আসলে তা নয়। দূরবর্তী সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শাসকেরা ’শিশিবোতল’ তো আছেই। এই মহৎ শব্দগুলোর আড়ালে তারা একান্ত ব্যক্তিতন্ত্র কায়েম করে। আর একান্ত ব্যক্তিতন্ত্র যদি হয় বিকারগ্রস্ত, তাহলে মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। যেমন এই মুহূর্তে উত্তর কোরিয়ার মানুষ ভীতির রাজত্বে বসবাস করছে। পৃথিবীর সর্বশক্তিধর রাষ্ট্রটির কর্তৃত্বেও নাকি এখন বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্র আরোপিত হয়েছে। লোকেরা ’পাগল’ ও ’আধাপাগল’ বলে উপহাস করে।
উপর্যুক্ত তিন প্রকারের ভীতিতন্ত্র- গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক, তাদের শাসনপ্রক্রিয়ার একমাত্র নাম হলো- ’ভীতি’। এই ভীতির মাধ্যমেই তারা নিজেদের রাজত্ব কায়েম রাখেন। তন্ত্রমন্ত্র জাহির করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেন। মোটকথা, ভীতিই তাদের বাহন। তারা প্রথমত, একটি ভীতির আবহাওয়া তৈরি করেন। মারাত্মক ধরনের নৃশংসতা যেমন- ফাঁসি, দেখামাত্র গুলি, বন্দুক যুদ্ধের মতো বিনাবিচার হত্যা ইত্যাদি ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা নাগরিক সাধারণকে এই বার্তা দিতে চান যে, নাগরিকরা যদি সরকারের বিরোধিতা করে তাহলে পরিণতি ওরকমই হবে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের নির্বাহীব্যবস্থা, যাবতীয় চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সব সুযোগ-সুবিধাকে দলীয়করণের মাধ্যমে তারা কার্যত একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেন। যাতে অন্যেরা বোঝে যে, চৌকিদার থেকে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত তাদের লোক হতে হবে। তৃতীয়ত, তাদের আরেকটি রণকৌশল হচ্ছে- ভীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করা। এর মাধ্যমে তারা গণমাধ্যম, সুশীলসমাজ এমনকি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে স্তাবকে পরিণত করেন। চতুর্থত, এই তিনটি কাজের মাধ্যমে সমাজে এক ধরনের নির্লিপ্ততা, নিস্পৃৃহতা ও নীরবতা কায়েম করা হয়। মানুষ তার নৈতিক সাহস হারিয়ে ফেলে। এই ভীতির অবস্থা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে। পঞ্চমত, তারা অনাদর্শকে আদর্শে পরিণত করেন। তারা এর সপক্ষে একদল বুদ্ধিজীবী ক্রয় করেন। তারা সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংলাপ এবং টকশোর মতো বিষয়কে প্রশস্তিতে পরিণত করেন। এই পঞ্চবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিক সাধারণ অব্যাহত ভীতিপ্রবণতায় ভুগতে থাকে। কোনো কোনো রাষ্ট্রে দলের পক্ষ থেকে গুপ্তচর লেলিয়ে দেয়া হয়। দেশব্যাপী একটি ভীতি ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়। সেসব দেশে এমন আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয় যে, স্ত্রী স্বামীকে বিশ্বাস করে না।
আসলে শাসকদল এই ভীতি ও শঙ্কার মাঝে তাদের মসনদের চিরস্থায়ীকরণের পথ খোঁজে। এই অবস্থা যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, ততটাই তাদের গদির নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ’ভীতি আরো ভীতির সৃষ্টি করে। অবশেষে তা অনির্দিষ্টকালের অনিশ্চয়তায় পরিণত হয়’। তবে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী ভীতির অবসানও ঘটে। হতে পারে তা কোনো ছোট্ট ঘটনার মাধ্যমে, একজন ব্যক্তির নেতৃত্বের কারণে অথবা বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে। আমাদের আধুনিককালে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচার ধ্বংস হয়েছে আরববসন্তে। পাকিস্তানে সামরিক স্বৈরাচার পারভেজ মোশাররফের পতন ঘটেছে এক দশক পরে। এ দেশে ৯ বছর পর এরশাদের পতন হয়েছে গণআন্দোলনে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্বৈরাচারেরও পতন আছে, ভীতির রাজনীতিরও শেষ আছে।
দীর্ঘ অবতরণিকার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা আসলে নিজেদের হিসাব-নিকাশ কষতে চেয়েছি। এটা এখন ওপেন সিক্রেট, আমরা দীর্ঘ আট বছর ধরে এক ধরনের ভীতিকর রাজনৈতিক পরিবেশে বসবাস করছি। এখানে নেতা-নেত্রীদের সমালোচনা করলে মামলা হয়। মামলায় সশ্রম কারাদণ্ডও হয়। ফেসবুকে বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ প্রকাশিত হলে চাকরিচ্যুতও হতে হয়। দল না করার কারণে পিএসসি উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও চাকরি পাওয়া যায় না। এমনকি পিয়ন-চৌকিদারের চাকরিও অন্য দলের লোকেরা পাবে না। এখানে দলের লোকেরা এতটাই দলপ্রেমিক যে, কথার ছলে কথার কারণেও পিটুনি খেতে হয়।
তৃণমূলের নিতান্তই একজন গরিব মানুষ দল না করার অপরাধে রিলিফ পায় না। এ দেশের পুলিশ হাঁটুর নিচে গুলি করে। ছাত্রের চোখে টিয়ার গ্যাস ছোড়ে; ঘুষ না দিলে পঙ্গু করে দেয়। রাজনীতির অপরাধে চোখ তুলে নেয়া হয়। কথায় কথায় হামলা-মামলার শিকার হতে হয়। বিরোধীদলের মিছিল-মিটিং তো দূরের কথা, মানববন্ধনেও বাধা দেয়া হয়। জাতীয় স্বার্থে তেল, গ্যাস রক্ষা অথবা ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ আন্দোলনের মতো শান্তিপূর্ণ অবস্থানকেও ক্ষমতাসীনেরা সহ্য করে না। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর সাধারণ ছাত্রদের মিছিলকেও তাদের সহযোগীরা পণ্ড করে দেয়। তবে সম্ভবত ভীতির কার্যকারিতা শেষ হয়ে আসছে। দেশের স্বার্থেই এখন জনগণের জেগে ওঠার পালা। সুকান্তের ভাষায়, ’বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত’।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments