মুসলিম নারীদের সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ : মিয়ানমার বাহিনীর আরেক অস্ত্র!
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় গণধর্ষণের শিকার হওয়া ১৩ বছরের এই মেয়েটি পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের একটি উদ্বাস্তুশিবিরে :এএফপি
জাতিসঙ্ঘের এক অনুসন্ধানী দল জানিয়েছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নারীরা ধারাবাহিকভাবে সে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে তাড়ানোর অস্ত্র হিসেবে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণকে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
ঘটনা তদন্তে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেইসব ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন ঘটনা তদন্তে গঠিত জাতিসঙ্ঘের অনুসন্ধানী দল। জাতিসঙ্ঘের দুই কর্মকর্তা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে তাড়ানোর অস্ত্র হিসেবে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণকে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
মিয়ানমারের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাম্প্রতিক মানবাধিকার হরণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে ওই অনুসন্ধানী দল গঠন করেছে জাতিসঙ্ঘ। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের উদ্যোগে ওই দল তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চলমান তদন্তকে ভিত্তি করে রোহিঙ্গাদের ওপর সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় জাতিসঙ্ঘের ওয়েবসাইটে এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেই রিপোর্টে উঠে এসেছে আয়েশা (ছদ্মনাম) নামের এক নারীর বিপন্নতার কথা।
আরো অনেকের সঙ্গে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন আয়েশা। ২০ বছর বয়সী এই নারী এসেই লেডা আশ্রয় শিবিরের চিকিৎসাকেন্দ্রের শরণাপন্ন হন। তার গ্রামে যখন সেনাবাহিনী ঢুকে তখন গ্রামবাসী পালাতে শুরু করে। আয়শা ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, সেনারা এসেই বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে থাকে। সবাই পালাচ্ছিল। কিন্তু আমাকে তো আমার সন্তানের কথা ভাবতে হবে।
আয়েশা জানান, সেনা পোশাক পরে পাঁচজন এসেছিল তার বাড়িতে। এদের একজন তাকে ধর্ষণ করে আর বাকিরা তা দেখতে থাকে। যুদ্ধ-সংঘর্ষে যৌন সহিংসতার ব্যবহার সংক্রান্ত জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন এই সপ্তাহে বলেছেন, রাখাইনের নিরাপত্তা অভিযান নিয়ে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, যৌন নিপীড়নকে ‘সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর (রোহিঙ্গা) জীবিতদের তাড়িয়ে দেয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।’
সামিলার (ছদ্মনাম) পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। ‘আমি জানি না, কোথায় আমার স্বামী-সন্তান। আমি মানুষজনের কাছে বারবার জানতে চাইছি। কোনো খবর পাচ্ছি না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিনি বলেন, এরপর তিনি ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে ফিরে যান বাঁশ দিয়ে বানানো আশ্রয়স্থলে। এটাই এখন তাদের বসতবাড়ি। সামিলা বলেন, যখন তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে আসছিলেন তিন দিনের পথ হেঁটে, তখনো তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তিন সেনা আমাকে ধর্ষণ করে। তারা চলে যাওয়ার পর আমি দুই সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। জীবনের তাগিদে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ধেয়ে আসতে থাকা মানুষের কাতারে শামিল হই।’
এবিসি রেডিওর সাংবাদিক লিয়াম কোচরেন। রাখাইনে প্রবেশের সুযোগ হয়েছিল তার। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। তা সত্ত্বেও কৌশলে তিনি বের করে এনেছেন সেখানকার ভয়াবহতা। রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে এবিসিতে তিনি রিপোর্ট করেছেন, ‘রাখাইনের ভয়ঙ্কর সব ধর্ষণের গল্প বলছেন নারীরা’ শিরোনামে।
রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজন অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন মোহাম্মদ কাশিম। বাড়ি ছিল, গাড়ি ছিল, ছিল একটা সুখী পরিবার। তবে হঠাৎই একদিন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তার বাড়িতে ঢুকে তছনছ করে দেয় সব। কাশিমের সামনে তার মেয়েকে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ করে সেনারা। সে সময় বাধা দিতে গেলে বন্দুক আর ছুরির মুখে আটকে রাখা হয় তাদের। কাশিম বলেন, ধর্ষণের পর আমার মেয়েকে মেরে ফেলা হয়। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।’
নারীদের স্বামী কিংবা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন যখন বাড়িতে থাকেন না তখনই ঢুকে পড়ে মিয়ানমারের সেনারা। সন্তানদের সামনে ধর্ষণ করে তাদের মাকে। জাতিসঙ্ঘের অভিবাসন সংস্থার লেডা আশ্রয় শিবিরের এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত আছেন নওরিন তাশনুপা। তিনি বলেছেন, প্রায় সব নারীকেই ধর্ষণ করা হয় পেটানোর পর। নওরিন জানান, ধর্ষিতা নারীদের থেঁতলে যাওয়া শরীর আর বুক কিংবা যৌনাঙ্গে কামড়ের চিহ্ন দেখেছেন তিনি। নওরিন বলেন, মানুষ এইসব ঘটনা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করত চান না। গত অক্টোবর থেকে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। তবে আমাদের কাছে একটা অভিযোগ আসতে তিন-চার মাসও লেগে গেছে।’
জাতিসঙ্ঘ অভিবাসন সংস্থার যৌন সহিংসতা থেকে সুরক্ষা সংক্রান্ত কর্মকর্তা ইরিন লরিয়া। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য এই মুহূর্তে এটি টিকে থাকার লড়াই। তার মতে, ধর্ষণকে অস্ত্র বানানো হয় নানাভাবে। ইরিন জানান, ‘এক সময় ধর্ষণকে ব্যবহার করা হতো নিপীড়নের একটি উপায় হিসেবে।
প্রকাশ্যে নগ্ন করে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়ানো হতো রোহিঙ্গা নারীদের, তাদের ওপর যৌন সহিংসতা চালানো হতো।’ তবে ইরিনের ভাষ্য অনুযায়ী সবশেষ ধাপে জাতিসঙ্ঘ বিশেষজ্ঞরা সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের যে আলামত পেয়েছেন, সেখানে ধর্ষণকে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের বিরুদ্ধে ভীতি ছড়াতে। সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনাগুলো বিচার করে তার মনে হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়াই এগুলোর উদ্দেশ্য।
জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল জানায়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। যুদ্ধে যৌনসহিংসতাবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সহিংসতা এবং সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
রাখাইনে এখনো নির্যাতন চলছে : জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী হাইকমিশনার
এ এম আশেক উল্লাহ
জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন এখনো অব্যাহত রয়েছে। এই অমানবিক নির্যাতনে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেন এবং নির্যাতিত অনেক রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সাথে কথা বলে তাদের নির্যাতনের বীভৎস কাহিনী শুনেন।
পরে আজ রোববার দুপুরে কক্সবাজারস্থ ইউএনএইচসিআর কার্যালয় প্রাঙ্গণে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রোহিঙ্গাদের যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা সকলেই মানসিকভাবে আহত এবং চরমভাবে বিধ্বস্ত। কেউ গুলির আঘাতে আহত, কেউ ধর্ষণের শিকার। তিনি তার বক্তব্যে সেনাদের হামলায় গুরুতর আহত রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন।
তিনি জানান, এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা দেশত্যাগ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এমুহূর্তে তাদের জন্য খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা, আশ্রয় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী খুবই প্রয়োজন। তিনি এখনও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন ও গণহত্যা বন্ধ করার আহবান জানান।
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তার বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বৈঠকে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য আগ্রহী। কিন্তু সমস্যা সমাধানের মূল বিষয়টি মিয়ানমারের কাছে। তাই মিয়ানমারকেও এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতে হবে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সামাল দেয়া বাংলাদেশ সরকারের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তাই তিনি দাতাসংস্থাগুলোকে সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহবান জানান।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা একদিকে রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী অন্যদিকে তাদের নাগরিকত্বও নেই এই দুইটি বিষয় তার মনে বেশি বেদনা সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, ‘আমার কক্সবাজার আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধন কিভাবে করা যায় তার উপায় খুঁজে বের করা।
No comments