একের পর এক দুর্ঘটনাঃ বিমানের ভাবমূর্তি তলানীতে
ফাইল ছবি।
যাত্রী থাকছে মাত্র ৪৭ জন। একমাত্র অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ছাড়া অধিকাংশ আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে গড়ে অর্ধেক আসন খালি থাকছে প্রতিদিন। গত অক্টোবরে পর পর দুটি দুর্ঘটনার পর দুটি উড়োজাহাজের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এতে ১০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয় বিমানের। কিন্তু বিমানের পরিচালনা পর্যদ ও ম্যানেজমেন্ট কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এর আগে গত ডিসেম্বরে মাসকট থেকে উড্ডয়নের পর বিমানের একটি চাকা ফেটে গেলে চরম ঝুঁকি নিয়ে ফ্লাইট অবতরণ করতে হয়েছিল শাহজালালে। তারও কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। এবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। উড্ডয়নের পর পরই বিমানের একটি ফ্লাইটের চাকা খুলে ছিটকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ক্যাপ্টেনের দক্ষতায় ফ্লাইটটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করতে সক্ষম হয়। এ অবস্থায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে সরকার ও মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন পরিচালনা পর্যদ গঠিত হওয়ার পর গত দুই বছরে বিমানে বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রতিমাসে চারবার পর্যদ সভা ডেকে কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ আর বিএফসি’র মুখোরোচক খাবার খাওয়া ছাড়া এ পরিচালনা পর্যদ বিমানের উন্নয়নে বড় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। জানা গেছে, নতুন পর্যদ গঠন হওয়ার আগে বিমান ৫৭০ কোটি টাকা লাভ করেছিল। এরপর থেকে বিমান আর লাভের মুখ দেখেনি। উল্টো মুনাফা ভেঙে খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিমানের বিরুদ্ধে। দুই বছর আগে বিমানের নতুন উড়োজাহাজ উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেছিলেন, বিমান ৫৭০ কোটি টাকা লাভ করেছে। বিমানের বহরে যোগ হয়েছে ৬টি নতুন উড়োজাহাজ। অর্থাৎ মরা গাছে সবুজ পাতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সবুজ পাতা ঝরে গেছে। মরা গাছটিও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এ মুহূর্তে বিমানকে বাঁচাতে দ্রুত বিমানের নতুন সিইও নিয়োগ ও পরিচালনা পর্যদ পুনর্গঠনের দাবি করেছেন।
জানা গেছে, সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের ড্যাশ ৮ উড়োজাহাজ ৬৬ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। কিন্তু উড্ডয়নের পর পরই উড়োজাহাজের একটি চাকা খুলে পড়ে যায়। পরে ঢাকায় এলেও জরুরি অবতরণ করতে হয় উড়োজাহাজটিকে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জরুরি অবতরণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর নিরাপদে সেটা অবতরণ করে। তবে কি কারণে এটা ঘটেছে তা অনুসন্ধান শেষে বিস্তারিত জানা যাবে বলে জানিয়েছেন পরিচালক আলী আহসান বাবু। তিনি জানান, এতে কোনো হতাহত হয়নি। চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিমানের ডেপুটি চিফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন এনামের নেতৃত্বে কমিটিকে ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, সৈয়দপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে উড্ডয়নের পর সেখানকার কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ক্যাপ্টেনকে জানানো হয় যে, ফ্লাইটটি উড্ডয়নের পর একটি চাকা খুলে পড়ে গেছে। এ সংবাদ পেয়ে ফ্লাইটের অপারেটিং ক্যাপ্টেন আতিক রহমান ও ফাস্ট অফিসার ইয়ামিন ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইর্মাজেন্সি ল্যান্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন। সে মোতাবেক ঢাকায় ইর্মাজেন্সি ল্যান্ডিংয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে ক্যাপ্টেন আতিক রানওয়ের ওপর লো লেভেল ফ্লাই করলে তাকে জানানো হয়, পেছনের ডান পাশের ৪ নম্বর চাকাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব প্রস্তুতি শেষে ক্যাপ্টেন আতিক নিরাপদে ও সফলভাবে ফ্লাইট অবতরণ করান। আরোহী ও উড়োজাহাজের কোনো ক্ষতি হয়নি। জরুরি অবতরণের সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ক্যাপ্টেন জামিলসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বারবার কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, বারবার বলছেন কেন? আপনারা সব কিছুকে এভাবে দেখছেন কেন? এ ঘটনায় পাইলট অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিরাপদে অবতরণ করেছে। এ জন্য পাইলটকে পুরস্কৃত করা উচিত। এতগুলো যাত্রীকে নিরাপদে রেখে যেভাবে ল্যান্ড করেছে সেটাই হাইলাইট করতে হবে। কিন্তু উড়ন্ত অবস্থায় কেন চাকা খুলে পড়ে যায়, অন্য কোনো এয়ারলাইন্সের তো এ ধরনের ঘটনা ঘটে না, এ জন্য কি কেউ দায়ী নয়? এটা কি ইঞ্জিনিয়ার শাখার অবহেলা নয়? এমন প্রশ্ন করা হলে রাশেদ খান মেনন বলেন, সেটা ভিন্ন কথা। সেটা আপনারা খুঁজে বের করুন।
তবে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও রিজেন্ট এয়ারলাইন্সের সাবেক সিওও (চিফ অপারেটিং অফিসার) আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, আমার জীবনে এমন ঘটনা দেখিনি। সাধারণত উড্ডয়নের সময় চাকা ফেটে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। এ অবস্থায় অবতরণ করাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এক চাকার ওপর নির্ভর করেও অবতরণ করা যায়। কারণ একটা চাকা নষ্ট হলেও সার্পোটিং আরেকটা চাকা থাকে। সেটাই যথেষ্ট। কিন্তু উড্ডয়নের পর চাকাই খুলে পড়ে যায় এবং সেটাকে পরে খুঁজে বের করতে হয় এটা তো অস্বাভাবিক ঘটনা। এর মানে বিমানের প্রকৌশল শাখায় ঠিকমতো উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হচ্ছে না। ওই উড়োজাহাজ উড্ডয়নের আগে চেক আপে সেটা ধরা পড়ল না কেন? চাকা সংযুক্তিতে বড় ধরনের দুর্বলতা ও ত্রুটি ছিল বলেই এমনটি ঘটেছে।
আশীষ রায় বলেন, আসলে বিমানের প্রকৌশল শাখার প্রতি কারও কোনো নজর নেই, গুরুত্ব নেই। যে কারণে ৭ মাস ধরে এখানে পরিচালকের পদ শূন্য থাকলেও সেটা পূরণ করতে পারছে না বিমান। শুধু তাই নয়, বর্তমানে বিমানের কাস্টমার সার্ভিস বিভাগ, স্টোর বিভাগ, পরিকল্পনা বিভাগসহ ৫টি বিভাগ পরিচালকবিহীন চলছে।
গাড়ির আঘাতে বিমানের ইঞ্জিন চুরমার : গত অক্টোবরে গ্রাউন্ড সাপোর্ট শাখার বেল্টারের (গাড়ি) আঘাতে বিমানের একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এছাড়া প্রকৌশল শাখার মেরামত করা গাড়ির আঘাতে অপর একটি উড়োজাহাজও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। দুটি দুর্ঘটনায় অচল হয়ে পড়ে দুটি এয়ারক্রাফটই।
প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, বেল্টার চালকের অসাবধানতা ও অদক্ষতায় উড়োজাহাজের ইঞ্জিন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে বিমানের শত কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হলেও ওই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ বিমানের প্রকৌশল ও জিএসই শাখার কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি কোনো তদন্ত কমিটিও করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, প্রতিটি ঘটনাই আড়াল করছে বিমান কর্তৃপক্ষ। শুধু তা-ই নয়, খোদ পরিচালনা পর্ষদও ম্যানেজমেন্টের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গত নভেম্বরে হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। জুলাইয়ে একজন অপারেটরের গাড়ির আঘাতে একটি ৭৭৭ উড়োজাহাজ অচল হওয়ার পরও বিমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দুটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি একাধিক সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি বিমান।
চাকার পিন না খুলে বিমানের উড্ডয়ন : লাল ফিতা বাঁধা সেফটি পিন না দেখে বিমানের ইঞ্জিন চালু করার নিয়ম নেই। বোয়িং চেক লিস্ট অনুযায়ী ল্যান্ডিং গিয়ারের চাকা থেকে পিন খুলে বিমানের ককপিটে বসে থাকা পাইলটকে দেখাতে হয়। পিনের মাথায় লাল ফিতা বাঁধা থাকে, যাতে সহজে পাইলট ককপিটে বসে পিনটি দেখতে পান। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, গত ২ জুন ব্যাংককগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের পাইলট ওই লাল ফিতার ঝাণ্ডা না দেখেই বিমানের ইঞ্জিন চালু করেন। এ ঘটনায় আকাশে বিমানের চাকা গুটাতে না পেরে পাইলটকে ৫০ মিনিট তেল পুড়িয়ে ফের জরুরি অবতরণ করতে হয়।
যাত্রীসহ বিমান ফেলে শপিংয়ে পাইলট : এর আগে ককপিটের দরজা লাগিয়ে যাত্রীবোঝাই একটি ফ্লাইট ফেলে ব্যক্তিগত কেনাকাটা করতে ডিউটি ফ্রি শপে গিয়েছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুই পাইলট। তখন উড়োজাহাজটির এপিইউ (অক্সিলারি পাওয়ার ইউনিট) সচল ছিল। চালু ছিল ইঞ্জিনসহ বিমানের সব অংশ। চিফ পার্সারের নেতৃত্বে কেবিন ক্রুরা ব্যস্ত ছিলেন যাত্রীদের আসনে বসানোর কাজে। কিন্তু ছিলেন না ফ্লাইটের মূল কমান্ডিং অফিসার দুই পাইলট। ঘটনাটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। এটি ঘটেছে ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেয়া টাস্কফোর্স তাদের রিপোর্টে বলেছে, ১৯৮৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট ৩২ বার বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত রিপোর্ট গায়েব করে দেয়া হয়েছে। টাস্কফোর্স এসব দুর্ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ না করার জন্য ফ্লাইট সেফটি বিভাগের দায়িত্ব অবহেলা বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অধিকাংশ বিমান দুর্ঘটনা পাইলটদের অবহেলা কিংবা ‘হিউম্যান এরর’ জনিত কারণে সংঘটিত হয়েছে। এজন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যেসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা রীতিমতো হাস্যকর। রিপোর্টে বলা হয়, অভিজ্ঞ পাইলটদের হাতে যেসব দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তা কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। পাইলটগণ তাদের ব্যক্তিগত ভুলের জন্য বিভিন্ন দুর্ঘটনার মাধ্যমে বিমানের মিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতি করেছে। এসবের মাধ্যমে পাইলটরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিমানের ব্যাপক ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি অতীতে।
No comments