সাত বছরে রাজধানীতে খুন আ’লীগের ২৯ নেতাকর্মী ,আসামিদের অধিকাংশই নিজ দলের

অন্যতম হত্যাকারী যুবলীগ নেতা জাহিদ সিদ্দিকী তারেক র্যাববের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। যুবলীগের দুই নেতার মৃত্যুর পর তাদের অনুসারীরা এখন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। বিভিন্ন খাতের চাঁদাবাজি ও অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে যুবলীগই এখন যুবলীগের প্রতিপক্ষ। এ বিভক্তির জেরে মিল্কী হত্যার তিন বছর পর গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর মতিঝিলে খুন হন যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান বাবু।
যুগান্তরের অনুসন্ধান, পুলিশের দেয়া তথ্য এবং স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব, গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, পরিবহন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসা, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ক্যাবল ব্যবসা, দখলবাজি, স্থানীয় নির্বাচনসহ নানান বিরোধকে কেন্দ্র করে বিরোধই এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ। আর এসব হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা অধিকাংশ মামলার আসামি আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহেযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্র্মীদের মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানান বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়ে থাকে। এগুলো দলের কোনো দ্বন্দ্ব নয়। অনেক সময় জনপ্রতিনিধিরা দল ভারি করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে থাকে। তবে কোনো ধরনের দ্বন্দ্বের তথ্য পেলে তা নিরসনে আমরা উদ্যোগ নিয়ে থাকি।’
২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে খুন হওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী একাধিক নেতাও রয়েছেন। ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই গুলশানে খুন হন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কী। মতিঝিল এলাকার আধিপত্য বিস্তার, চাঁদার ভাগ-ভাটোয়ারা এর অন্যতম কারণ। ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধও এ খুনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। এ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরাও স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি সূত্র জানায়, মিল্কী ও তারেকের মৃত্যুর পর মতিঝিল এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ও নাসিরের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। নাসির মিল্কীর অনুসারী ছিল। আর বাবু ছিল তারেকের অনুসারী। মতিঝিল এলাকার সরকারি কাজের ঠিকাদারি, গার্মেন্ট কারখানার চাঁদাবাজি ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাতের চাঁদাবাজি, জুয়া ও হাউজির চাঁদাবাজি, ডিশ ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতের চাঁদাবাজিতে তারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়ে। প্রতি মাসে বিভিন্ন খাত থেকে দুই কোটি টাকার বেশি চাঁদা উঠে। এসবের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই ১৬ সেপ্টেম্বর মতিঝিলে যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান বাবুকে হত্যা করে নাসির গ্রুপের লোকজন। ২০১৩ সালেল ৭ নভেম্বর মতিঝিলে নৃশংসভাবে খুন করা হয় ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সায়েদাবাদ টার্মিনালের বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম মোল্লাকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে। ডিবির অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সায়েদাবাদ টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম এ খুনের মাস্টারমাইন্ড। আবুল কালাম টার্মিনালে একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে খায়রুল আলম মোল্লাকে খুন করিয়েছেন। পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন টার্মিনালের কিশোরগঞ্জ রুটের আন্তঃজেলা বাস শ্রমিক লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক তৈয়ব আলী।
ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনোখুনি : ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট গার্মেন্টের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে বাড্ডায় ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান গামা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা শামসু মোল্লাসহ চারজন খুন হন। চার খুনের তিন মাস আগে ৩ মে বাড্ডা জাগরণী সংসদ ক্লাবে গুলি করে হত্যা করা হয় থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রায়হানকে। একই বছরের ১০ আগস্ট কাফরুলের সৈনিক লীগ নেতা রুবেল হোসেনকে হত্যা করা হয়। মিরপুর, কাফরুল, পল্লবী এলাকার গার্মেন্ট ঝুট ব্যবসার দ্বন্দ্বের জেরে এ ঘটনা ঘটে। ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট ঢাকা মহানগর যুবলীগের ৯২ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি শাহ আলী রকিকে হত্যা করা হয়।
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনোখুনি : চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর আদাবরে খুন হন ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতা মশিউর রহমান মশু। পুলিশ বলছে, স্থানীয় আধিপত্য, অবৈধ আয়ের ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে মোল্লা স্বপনসহ অধিকাংশই যুবলীগের নেতাকর্মী। চলতি বছরের ৯ আগস্ট মোহাম্মদপুরে খুন হন স্থানীয় যুবলীগ কর্মী তছির উদ্দিন। ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল চাঁদাবাজি ও এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে খুন হন খিলগাঁও জোড়পুকুর এলাকার যুবলীগ নেতা মো. আরিফ হোসেন। একই কারণে ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি মগবাজারে খুন হন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান রানা। ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শ্যামপুরে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রিয়াজুল ইসলাম লালুকে তার দোকানে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে আসাদুজ্জামান আল ফারুক নিহত হন। ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট মালিবাগে খুন হন ২৩ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোক্তার হোসেন। ২০১৩ সালের ২৭ মে লালবাগ থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক রতন ওরফে সেলিম খুন হন। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক খুন হন। ফজলুল হক খুনের তিন বছর পর ২০১৪ সাালের আগস্টে খুন হন ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম। ২০১১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এলাকায় স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান মিঠুকে হত্যা করা হয়। ২০১০ সালের আগস্টে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে হত্যা মামলায় ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয় মোহাম্মদপুরের ছাত্রলীগ নেতা অহিদুজ্জামান রুমিছকে।
আরও যত খুনোখুনি : ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কদমতলীতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রায়হান কবিরের পরিকল্পনায় থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ ও তার গাড়িচালক খুন হন। এ ঘটনায় রায়হান কবির ও তার ছয় সহযোগীর ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন আদালত। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে গুলশানের কালাচাঁদপুরে হত্যা করা হয় যুবলীগ নেতা মাইনুদ্দীনকে।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের উপ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক রাজিবুল হাসান রাজীব পুরান ঢাকায় খুন হন। ২০১৫ সালের আগস্টে ওয়ারীতে খুন হন ৩১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান। ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল জমিসংক্রান্ত বিরোধে খুন হন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের ৯৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি একেএম ফজলুল হক পাটোয়ারী ওরফে বাবু। ২০১১ সালে লালবাগে খুন হন ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ সিকদার।
No comments