নবাব সিরাজউদ্দৌলা
নবাব আলী আব্বাসউদ্দৌলা
নবাব।
পলাশীর যুদ্ধে তার পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। সিরাজউদ্দৌলা তার নানা নবাব আলীবর্দী খানের কাছ থেকে ২৩ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাবের আসনে বসেন। প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে লর্ড রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণ করে।
১৭৪৬ সালে আলীবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে কিশোর সিরাজ তার সঙ্গী হন। আলীবর্দী সিরাজউদ্দৌলাকে বালক বয়সেই পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
তার বয়স অল্প ছিল বলে রাজা জানকীরামকে রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু বিষয়টি সিরাজউদ্দৌলাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই তিনি একদিন গোপনে কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে ভ্রমণের নাম করে স্ত্রী লুত্ফুন্নেসাকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে বের হয়ে পড়েন। তিনি সোজা পাটনা গিয়ে উপস্থিত হন এবং জানকীরামকে তার শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু নবাবের বিনা অনুমতিতে জানকীরাম সিরাজের কাছে শাসনভার ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। দুর্গের দ্বার বন্ধ করে বৃদ্ধ নবাবের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দূত পাঠান। অন্যদিকে জানকীরামের আচরণে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে সিরাজউদ্দৌলা দুর্গ আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষে লড়াই শুরু হয়ে গেলে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে আলীবর্দী খান দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। সেদিনই আলীবর্দী খাঁ দুর্গের অভ্যন্তরস্থ দরবারে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন, ‘আমার পরে সিরাজউদ্দৌলাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে। ’ ইতিহাসে এ ঘটনাকে সিরাজউদ্দৌলার যুবরাজ হিসেবে অভিষেক বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই সময়ে সিরাজউদ্দৌলার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। সিরাজকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করার ঘটনা তার আত্মীয়বর্গের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। অনেকেই তার বিরোধিতা শুরু করেন। সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসেই প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। মীরজাফরকে সেনাবাহিনীর প্রধান বখশির পদ থেকে সরিয়ে মীর মদনকে সেখানে নিয়োগ দেন। এ ছাড়া মোহনলালকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করা হয়। এরপর সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কলকাতায় অবস্থিত কাশিমবাজার কুঠির ব্যাপারে মনোযোগী হন। কারণ সিরাজউদ্দৌলা তাদের এ দেশে কেবল বণিক ছাড়া আর কিছু ভাবেননি। এ কারণে ১৭৫৬ সালের ২৯ মে কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করা হয়। ফলে ইংরেজরা নবাবের হাতে যুদ্ধাস্ত্র তুলে দিয়ে মুচলেকার মাধ্যমে এ যাত্রায় মুক্তি পায়। কলকাতার নাম বদল করে নবাব আলীবর্দী খানের নামানুসারে আলীনগর রাখা হয়।
এ ঘটনার পর ইংরেজরা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। তারা জগেশঠের মাধ্যমে মীরজাফরকে মসনদে বসানোর চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে ফেলে। পরিকল্পনায় আরও যোগ দেন ঘসেটি বেগম, মীরজাফরের পুত্র মীরন, জামাতা মীর কাশিম, রাজা রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, মীর খোদা ইয়ার খান লতিফ প্রমুখ। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ১৭৫৭ সালের ৫ জুন মীর জাফরের একটি গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার ফসল ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ। চুক্তি সম্পাদনের পরই রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর প্রান্তরে সৈন্য সমাবেশ ঘটান। সিরাজউদ্দৌলাও তার সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু এ সময় মীর মদনের পরামর্শ উপেক্ষা করে কোরআন শরিফে হাত রেখে শপথের বিনিময়ে মীরজাফরকে পূর্বপদে বহাল করেন। ইংরেজদের সঙ্গে গোপন চুক্তির বিষয়ে সিরাজউদ্দৌলা অবগত হলেও মীরজাফরের অনুগত সেনাদের সংখ্যা ও যুদ্ধাস্ত্রের পরিমাণ বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এর ফলে সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্তে সিরাজউদ্দৌলা সাহসিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। সিরাজউদ্দৌলা কিছু বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে রাজধানীতে ফিরে যান। কিন্তু ২৯ জুন তাকে পলাতক অবস্থায় স্ত্রী-কন্যাসহ আটক করা হয়। এরপর ৩ জুলাই মীর াফরের পুত্র মীর সাদিক আলী খান মীরনের নির্দেশে মুহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলকে হত্যা করেন। উল্লেখ্য যে, অনাথ মুহাম্মদী বেগ আলীবর্দী খানের স্ত্রী শরফুন্নেসার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন এবং প্রচুর ধনসম্পদ দান করে তিনি তাকে বিত্তশালী করেছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যও অস্তমিত হয়।
লেখক : নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর।
Post Comment
No comments