সুপার স্টার ফজলে লোহানী


সুপার স্টার ফজলে লোহানী
(এ দেশের টেলিভিশনের প্রথম সুপার স্টার, টিভি সাংবাদিকতার জনক প্রয়াত ফজলে লোহানীর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ রচনা। )
‘প্রত্যেক মৃত্যুই আমায় ছোট করে ফেলে, জিজ্ঞেস কর না, ওই দুঃখের ঘণ্টাধ্বনি কার মৃত্যুর বারতা ঘোষণা করছে।

তোমার জন্যই বাজছে ওই ধ্বনি। ’—মৃত্যুর কিছুদিন আগে শেষ অনুষ্ঠানটিতে লোহানী ভাই এ কথাগুলো বলেছিলেন। জানি না ওই কথাগুলো বলে তিনি নিজের মৃত্যু বারতাই ঘোষণা করেছিলেন কিনা। ১৯৮৫ সালের ৩০ অক্টোবর লোহানী ভাই আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন। দেখতে দেখতে ৩২টি বছর কেটে গেল। তবুও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তিনি নেই। মানুষকে একদিন চিরবিদায় নিতে হবে— এটাই স্বাভাবিক, এটাই চিরসত্য। কিন্তু সেটা কি এভাবে? কবি শামসুর রাহমানও তার কবিতায় একইভাবে প্রশ্ন করেছেন—‘মানুষ চলেই যায় শেষ অবধি, তা’বলে কি এরকম চলে যেতে হয়?’ একজন সাংবাদিক, একজন মানবতাবাদী, উদার হৃদয়ের বিবেকবান ‘আধুনিক মানুষ’ হিসেবে ফজলে লোহানী শুধু সমাজের উঁচুতলার মানুষই নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।
লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি।
লোহানী ভাইকে কাছ থেকে যতই দেখেছি ততই অবাক হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি। জেনেছি তার প্রবাস জীবনের অনেক ইতিহাস, বিবিসিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা, জেনেছি ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোর গল্প। জেনেছি তার সাংবাদিকতা জীবনের অজানা কথা। কী অসাধারণ মেধাসম্পন্ন মানুষ অথচ কত সাধারণ তার জীবনযাপন। বেশভূষায় ও চালচলনে তিনি ছিলেন আধুনিক। চিন্তাধারায় তিনি ছিলেন প্রগতিশীল এবং মানবদরদি। কাজকর্মে তিনি ছিলেন দুঃসাহসী। জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতায় তিনি ছিলেন প্রাচ্য ও পশ্চিমের মিশ্রণ। সদা হাসি খুশি মানুষ ছিলেন ফজলে লোহানী। কখনো বুদ্ধিজীবীর ভাব ধরে গম্ভীর হয়ে থাকতেন না। প্রায়ই বলতেন, ‘আজকালকার বুদ্ধিজীবীরা কষ্ট করে হাসেন। ভয়-যদি দাঁতের ফাঁক দিয়ে বুদ্ধি স্লিপ করে। আমার এ সমস্যা নেই, তাই প্রাণ খুলে হাসতে পারি। ’ আপন বিশ্বাস ও জীবনাচরণের মধ্যে কখনো কোনো ফাঁকির প্রশ্রয় দেননি। তিনি বলতেন কম, করতেন বেশি। সব সময় কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। প্রায়ই বলতেন, ‘জীবনটা খুবই ছোট কিন্তু কাজ অনেক বেশি। তাই সময় নষ্ট করা ঠিক নয়। ’ মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তমনের মানুষ ছিলেন বলেই, আমরা যারা তার চেয়ে বয়োকনিষ্ঠ ছিলাম তাদের সঙ্গেও অনায়াসে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। একসঙ্গে দীর্ঘদিনের পথচলায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার বন্ধু এবং অভিভাবক। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে তিনি যে শুধু বয়সের ব্যবধান দূর করেছেন তাই নয়, প্রাণ খোলা হাসি দিয়ে অনেক অপরিমেয় দুঃখকেও তিনি জয় করেছেন। এতগুলো বিরল বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ের ফলেই ফজলে লোহানী হতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম টিভি সুপার স্টার। যে কারণে তার মৃত্যুর পর সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’র প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছিল ‘গুডবাই সুপার স্টার ফজলে লোহানী’ (৩ নভেম্বর ১৯৮৫)। সে সময় সুপার স্টার হওয়া এতটা সহজ ছিল না। এখন তো ২-১টি চ্যানেলে মুখ দেখালেই কিছু অতি উৎসাহী পত্রিকার কল্যাণে শুধু সুপার স্টারই নয় কিংবদন্তি খেতাবও জুটে যায়। যার ফলে শব্দগুলোও এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও পত্রিকায় আর টিভি টকশোতে সাক্ষাত্কার তো আছেই। তখন অবশ্য এত চ্যানেল, এত পত্রিকা ছিল না। সুতরাং পর্দা বা পাতা ভরানোর তাগিদও ছিল না। তাই অপাত্রে এসব শব্দ প্রয়োগ হতো না। তবে যে যাই বলুক বা লিখুক না কেন-এ যুগে এসে ফেসবুকের কল্যাণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজের স্বাধীন মতামত পড়লেই এসব বিষয়ে সঠিক মূল্যায়ন পাওয়া যায়। যার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব অতি উৎসাহী পত্রিকার মতামতের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সে সময় টিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য। লোহানী ভাই প্রায়ই বলতেন, টেলিভিশন বা ছবি যাই বলি না কেন-এখানে দর্শক শ্রোতার বয়স বা শ্রেণিভাগ করাটা ঠিক নয়। একটি অনুষ্ঠান বা ছবি সব বয়সের সব শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য হওয়া উচিত। যা পরিবারের ছোট-বড় সবাইকে নিয়ে পারিবারিক পরিবেশেও দেখা যাবে। কাজটি সবার কাছে প্রিয় হতে পারাটাই সার্থকতা। যা সবাই মিলে দেখা যাবে না সেখানে লেখা থাকে ‘শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’। সুতরাং নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণি বা নির্দিষ্ট বয়সের জন্য কোনো কিছু নির্মাণ করলে তা লিখে দেওয়াই ভালো। নইলে অন্যের সময় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিপত্তিও ঘটতে পারে। কারণ ইদানীং কিছু কিছু ছবির দৃশ্য এবং সংলাপ শুনে অনেক দর্শকই মন্তব্য করেন, ছবিটিতে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ কথাটা লেখা উচিত ছিল। সুতরাং নানাজনের নানা মত থাকবেই, তবে যিনি যা বানান তা প্রকাশিত, প্রচারিত বা মুক্তির আগেই ‘আমি সেরা জিনিস বানিয়েছি’ এমন ঘোষণা না দেওয়াই উত্তম। কারণ ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী ফলে পরিচয়’। যে ফল সব সময় সুস্বাদু নাও হতে পারে।
লোহানী ভাই ছিলেন এসবের বাইরে। তিনি ছিলেন নীরব কর্মী। কখনই নিজের ঢোল পেটাননি।   অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তিনি, যা তার টিমের সদস্যরা ছাড়া কেউ জানত না। যদিও হাল আমলের কিছু ব্যক্তির লেখা টিভির ইতিহাস সম্পর্কিত বইতে, মনগড়াভাবে লোহানী ভাইয়ের টেলিভিশন জীবনের অনেক সাফল্যের কথা সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন। বইজুড়েই রয়েছে আত্মপ্রচার। নিজের প্রচার করুক আপত্তি নেই কিন্তু অন্যের কীর্তি লুকানো বা ভুল তথ্য প্রদান অমার্জনীয় অপরাধ। লোহানী ভাই তার অনুষ্ঠান সম্পর্কে একবার একটি সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘আমি ইচ্ছে করেই অনেক সময় রিক্স নেই-আমি একবার বাচ্চাদের বই পড়ে দেখলাম তাতে অসংখ্য ভুল এবং তারা সেই ভুল জিনিসগুলোই শিখছে, একজন গরিব বাবা পয়সা দিয়ে সেই বানান ভুল এবং অসংগতিপূর্ণ বিষয়ে ভর্তি বইগুলো কিনে দিচ্ছে তার ছেলেকে। এই ভুল শোধরানোর কোনো সুযোগ এই ছেলেটি কখনই আর পাবে না। আমি একটি অনুষ্ঠানে বইগুলো ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি, ডাস্টবিনই হচ্ছে এগুলোর উপযুক্ত স্থান। ’ লোহানী ভাই বেঁচে থাকলে হয়তো এসব মিথ্যে তথ্যে ভরা বইগুলোর স্থানও হতো ওখানে।
উল্লেখ্য, আশির দশকে এই ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই লোহানী ভাই টিভি সাংবাদিকতার সূচনা করেন। বলা যায় বাংলাদেশের টেলিভিশনের রূপ পালটে দিয়ে তাকে শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত করার কাজে তিনি ছিলেন সফল পথিকৃৎ। তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় মুস্তাফা মনোয়ার বলেছেন, ‘টিভি শক্তিশালী মাধ্যম নয়, টিভির অনুষ্ঠান যিনি পরিবেশন করছেন তিনি যদি শক্তিশালী হন, কেবল তবেই টিভি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ’ মুস্তাফা মনোয়ারের এই মূল্যবান উক্তির প্রতিধ্বনি তুলে বলতে হয় ফজলে লোহানী টিভিতে উপস্থাপনা শক্তির যে মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন তা যেমন শিক্ষণীয় তেমনি অনুকরণীয়। অন্তত, আজকে যারা টিভি রিপোর্টিং বা টিভি সাংবাদিকতা করছেন, তাদের অনেকেই হয়তো জানেন না, এদেশে টিভি সাংবাদিকতার জনক ছিলেন ফজলে লোহানী। মুস্তাফা মনোয়ার, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কামাল লোহানী, শফিক রেহমানসহ তার সমসাময়িক অনেকেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন। বর্ণাঢ্য জীবন ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ফজলে লোহানী শিক্ষাজীবন শেষ করার আগেই রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় পরের বছর ‘অগত্যা’ নামে তিনি একটি পত্রিকা বের করেন। সে সময় সামাজিক ও সাহিত্য ক্ষেত্রেও সনাতনী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ‘অগত্যা’ ক্ষুরধার ভাষায় লিখে চলছিল। তাই পাকিস্তান সরকার যখন পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে দেন তখন পাঠককুল আশ্চর্য হননি। লেখক ও শিক্ষাবিদ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লোহানী ভাইয়ের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রচারিত ইত্যাদির একটি পর্বে লোহানী ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “প্রিন্ট মিডিয়া দিয়ে অর্থাৎ ‘অগত্যা’ পত্রিকা দিয়ে শুরু এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে অবসান অর্থাৎ ‘যদি কিছু মনে না করেন’ এই অনুষ্ঠান দিয়ে তার শেষ এবং সারা জীবন সে সাংবাদিকতাই করে গেছে। এখন স্মৃতিচারণ করতে গেলে একটা কথা মনে হয় ও নিজেই যেন একটা ইনস্টিটিউশনে পরিণত হয়েছিল। অগত্যা পত্রিকা নিয়েই আমার বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করে কারণ আমরা একত্র হয়েছিলাম ‘অগত্যা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই এবং পরবর্তীকালে যারা খুব বিখ্যাত লেখক হয়েছেন আমাদের যেমন ধরা যাক কবি শামসুর রাহমান, আনিস চৌধুরী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাঈদ আতিকুল্লাহ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আর সর্বকনিষ্ঠ আমাদের মধ্যে হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হক। আমাদের প্রত্যেকেরই গোড়ার দিক কার লেখা কিন্তু ‘অগত্যা’য়। অর্থাৎ আমরা এক অর্থে ‘অগত্যা’র সন্তান এবং ‘অগত্যা’ এক অর্থে সময়ের সন্তান। ”
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেছেন, “তিনি ছিলেন ইংরেজি এবং বাংলা দুটো দিকেই অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষ। যার কারণে তার লেখায় সেই দ্যুতির স্ফুরণ ঘটত। আমার সাংবাদিকতার গুরু হিসেবে তাকে মান্য করি আর সেই সঙ্গে একটি কথা বলে রাখি সেটা হলো আজকে এই যে টিভি সাংবাদিকতা শুরু হয়েছে এই টিভি সাংবাদিকতার যে পত্তন এটি কিন্তু এই ফজলে লোহানীর হাত দিয়েই। ” তবে পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট লেখকদের লেখা আজও বন্ধ হয়নি।
অলস ব্যক্তিদের দেখতে পারতেন না তিনি। সে জন্য সাইকেলে চড়ে নিজেই পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লোহানী ভাই তার একটি কলামে লিখেছেন, ‘উত্তর ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ ও যুগোস্লাভিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ভ্রমণ করে একদিন লন্ডন গিয়ে পৌঁছাই। সেদিন আমার পকেটে একটা ২০ পাউন্ডের ড্রাফট ছাড়া আর কোনো টাকা পয়সা ছিল না। দিনটি ছিল শনিবার বিকাল। অর্থাৎ ব্যাংক বন্ধ। ভিক্টোরিয়া স্টেশনের সামনে এক পুলিশের কাছ থেকে ছয় পেনি ধার নিয়ে টিউবে চেপে নিকটস্থ এক ইয়ুথ হোস্টেলে আশ্রয় নেই। ইরানের মরুভূমির মধ্য দিয়ে আমি নিঃসঙ্গ পথে মাইলের পর মাইল হেঁটে অতিক্রম করেছি। এর আগেই পাকিস্তানে সাইকেলটা বিক্রি করে দিয়েছিলাম অর্থাভাবে। রুটি আর পানি খেয়ে বহুদিন কেটেছে মরুভূমির মাঝে। সেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমার জীবনকে দিয়েছে এক নতুন অর্থবোধ। ’ আর এই অর্থবোধই হয়তোবা ব্যক্তি ফজলে লোহানীকে দিয়েছে দুঃখী মানুষের সেবা করার একটা বাস্তবমুখী অনুপ্রেরণা।
আজকাল অধিকাংশ অনুষ্ঠানে কাজের চেয়ে ‘কথা’ বেশি বলতে শোনা যায়। চলে আত্মপ্রচার আর আত্মপ্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। অথচ লোহানী ভাই যা করতেন নিজের দায়বোধ থেকে করতেন। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে করতেন। কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায় নয়। বলা বাহুল্য, দীর্ঘ ছয় বছর দাপটের সঙ্গে টেলিভিশনকে একটি শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত করলেও তার ভাগ্যে জীবদ্দশাতে তো নয়ই এমনকি মৃত্যুর পরেও কোনো মরণোত্তর পুরস্কার জোটেনি। শুধু পুরস্কারই নয়, দুঃখের বিষয় এখন তার মৃত্যুবার্ষিকীও তেমনভাবে পালিত হয় না। যাও হয়-তাও আবার কোনো টিভির সংবাদে সেভাবে স্থান পায় না। লোহানী ভাইয়ের মৃত্যুর কথা মনে হলেই মনে পড়ে ছোট মেয়ে রিপাকে। বাবা সামান্য টাকায় চাকরি করতেন। আদুরে কন্যা রিপার হার্টের অসুখে দিশাহারা হয়ে লোহানী ভাইয়ের কাছে আসেন একটুখানি সাহায্যের প্রত্যাশায়। লোহানী ভাই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রিপাকে ভর্তি করিয়ে দেন। এখনকার মতো তখন ওপেন হার্ট সার্জারি, এনজিওগ্রাম করা, রিং পরানোর বিষয়গুলো এত সহজসাধ্য ছিল না। প্রতি পদে পদে ছিল মৃত্যুঝুঁকি। লাখ লাখ টিভি দর্শকের দোয়া ও ভালোবাসা নিয়ে একসময় রিপার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। বাঁচার আশা ছিল না যে মেয়েটির, চিকিৎসার পর দিব্যি সুস্থ হয়ে এই রিপাই পরবর্তী আর একটি পর্বে লোহানী ভাইয়ের হাত ধরে হাসপাতালের বাইরে বাগানে নিয়ে আসে। বাগান থেকে ফুল নিয়ে রিপা তার প্রিয় লোহানী চাচার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। আশ্চর্য, অসুস্থ হয়ে এই হাসপাতালেই লোহানী ভাই ভর্তি হয়েছিলেন এবং অগণিত গুণগ্রাহীকে কাঁদিয়ে এই হাসপাতাল থেকেই চিরবিদায় নিয়েছেন।
টেলিভিশনের পর্দায় লোহানী ভাইয়ের অনুষ্ঠান দেখে যারা মুগ্ধ হতেন তাদের অনেকের স্মৃতিতেই হয়তো এখন লোহানী ভাই নেই, কিন্তু একজন আম্বিয়া, সাঁকো পারের রাবেয়া-যে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে, হাতকাটা আলতাফ, প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামীদের কথা, অ্যাসিড দগ্ধ বিউটিসহ যে অন্ধ কিশোরী লোহানী ভাইয়ের মাধ্যমে দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে তারা কখনই লোহানী ভাইকে ভুলতে পারবে না। কারণ তার মৃত্যুতে ওরাই কষ্ট পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। কত মানুষের মুখে যে তিনি হাসি ফুটিয়েছেন তা লিখে শেষ করা যাবে না। তাদের মিলিত কান্নায় তার আত্মার সুখের শান্তির ফরিয়াদ করছে। আজ তার এই ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে লক্ষ কোটি দর্শকের ভালোবাসার মানুষ, আমার অনুপ্রেরণা লোহানী ভাইকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নকর্মী।

No comments