আ’লীগ চায় জয় ও বিএনপি পুনরুদ্ধার রাজশাহী-৬ আসন
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭,বুধবার, ০০:০০
আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা বেশ
তৎপর। দলীয় মনোনয়ন কে পাবেন সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত না হলেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের সবাই দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এ জন্য দলীয় মনোনয়ন পেতে আগ্রহী নেতাদের অনেকেই কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের কাছে দেনদরবার ও লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। দলীয় প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নেতাদের বেশির ভাগই মাঠপর্যায়ে সক্রিয় রয়েছেন এবং গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আসনটিতে আওয়ামী লীগ চায় জয়। আর বিএনপি আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায়।
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন- পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি শাহরিয়ার আলম, চারঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি রায়হানুল হক রায়হান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লায়েব উদ্দিন লাভলু এবং বাঘা পৌরসভার মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আক্কাছ আলী।
এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন- বাঘা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি নূরুজ্জামান খান মানিক, চারঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাঈদ চাঁদ, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি বজলুর রহমান এবং জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল।
বাঘা-চারঘাটে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া দলটির বড় একটি ভোটব্যাংকও আছে। বর্তমানে বাঘা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা জিন্নাত আলী এবং চারঘাট উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নাজমুল হক দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী নির্বাচনে এ আসনটি থেকে জামায়াতের কোনো নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কিনা সে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে নির্বাচনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে দলটির কোনো ঘাটতি নেই। এ ব্যাপারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হবে সে অনুযায়ী নেতাকর্মীরা কাজ করবেন বলে স্থানীয় জামায়াতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
আর জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ আসনে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না তা দলটির তরফ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাঘা-চারঘাটে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থাও অনেকটা নড়বড়ে।
বাঘা ও চারঘাট উপজেলা মিলে রাজশাহী-৬ আসন গঠিত। এ দুইটি উপজেলায় ১২টি ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে বাঘা উপজেলায় ছয়টি ও চারঘাট উপজেলায় ছয়টি ইউনিয়ন। এ ছাড়া বাঘা উপজেলায় দুইটি পৌরসভা (বাঘা ও আড়ানী) এবং চারঘাট উপজেলায় একটি পৌরসভা (চারঘাট) রয়েছে।
এ দুইটি উপজেলায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী-সমর্থকদের সংখ্যাই বেশি। ফলে বিগত স্থানীয় সরকার পর্যায়ের এবং সংসদ নির্বাচনগুলোতে বেশির ভাগই বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। এমনকি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও এ দুইটি উপজেলায় বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের বেশির ভাগ বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত।
স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা: মো: আলাউদ্দিনকে (নৌকা প্রতীক) পরাজিত করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আজিজুর রহমান (ধানের শীষ প্রতীক) এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আজিজুর রহমান (ধানের শীষ প্রতীক) এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আরেকটি সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা: মো: আলাউদ্দীন আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর তিনি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তবে তিনি বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে পরে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে যান এবং আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত কিছু দিন পরে ডা: আলাউদ্দিনের মৃত্যু হলে তার শূন্য আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রায়হানুল হক রায়হান এমপি নির্বাচিত হন। আর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নূরুল ইসলাম ঠাণ্ডু নৌকা প্রতীক নিয়ে পরাজিত হন। পরে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রায়হানুল হককে পরাজিত করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট কবির হোসেন (ধানের শীষ প্রতীক) এমপি নির্বাচিত হন।
ধারাবাহিকভাবে বিএনপির এ বিজয় অর্জিত হতে থাকলেও এর ছেদ ঘটে ২০০৮ সালের নির্বাচনে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাহরিয়ার আলম এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে আবারো এমপি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাহরিয়ার আলম।
অবশ্য এর আগে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা: মো: আলাউদ্দিনকে (নৌকা প্রতীক) পরাজিত করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোকসেদ আলী এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা: আলাউদ্দিনকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নূরুন্নবী চাঁদ।
বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং বাঘা উপজেলা সভাপতি আনোয়ার হোসেন মিল্টন নয়া দিগন্তকে বলেন, এ আসনটিতে আওয়ামী লীগ জয় পেতে চায়। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এ আসনে আগামী নির্বাচনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি শাহরিয়ার আলম আবারো দলীয় মনোনয়ন পাবেন।
এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী চারঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি রায়হানুল হক রায়হান। তিনি বলেন, আমি দলীয় মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চাই। দলের হাইকমান্ড বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে আশা করি।
বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে অনেকটা স্বচ্ছ ভাবমর্যাদার নেতা হিসেবে পরিচিত বাঘা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি নূরুজ্জামান খান মানিক। তারা বলেন, বাঘায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বসার এবং দলীয় সভা করার মতো কোনো কার্যালয় ছিল না। তাই দলের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে নূরুজ্জামান খান মানিক সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে উপজেলা সদরে নিজের জমিতে বিএনপির বিশাল কার্যালয় নির্মাণ করেছেন। এরপর থেকে সেখানে প্রতিদিন নেতাকর্মীদের পদচারণায় জমে উঠে দলীয় কার্যালয়। এ কার্যালয়ে বসেই দলীয় সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়ে থাকে। তবে দলের জন্য ত্যাগ এবং যোগ্য নেতা হিসেবে আগামী নির্বাচনে নূরুজ্জামান খান মানিক দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে আশা করছেন তার অনুসারীরা। এ ব্যাপারে নূরুজ্জামান খান মানিক বলেন, সব দিক বিবেচনায় কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড আমাকে দলীয় মনোনয়ন দেবে বলে আশা করি।
এ দিকে বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি পরপর পাঁচ বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদে পরপর তিনবার, আর উপজেলা পরিষদে দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে জনপ্রিয়তা ও বিগত আন্দোলন কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের কারণে এবার বিএনপি নেতা চাঁদ দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে তিনি আশা করছেন।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেক নেতা হলেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি বজলুর রহমান। তিনি মনে করেন, এলাকার উন্নয়ন করতে হলে যোগ্য নেতার প্রয়োজন। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করে বজলুর রহমান বলেন, এলাকার মানুষ আমার সাথে আছেন। আমি আশা করি দল আমাকে মূল্যায়ন করবে।
এ ছাড়া জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। বিএনপি নেতা উজ্জ্বল বলেন, বিগত আন্দোলন কর্মসূচিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। এ ছাড়া এলাকাবাসীর মধ্যে তার ভালো সুনাম রয়েছে।
বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন, প্রার্থী মনোনয়নে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত বিবেচনায় নিতে হবে। বিগত সময়ে দলের দুঃসময়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, বিগত আন্দোলন কর্মসূচিতে মাঠে ছিলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেন এবং যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। তারা আরো বলেন, দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ এলাকাবাসীর সাথে যোগাযোগ রাখেন, তাদের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ান, সুনাম রয়েছে, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত নয় এবং জনপ্রিয়তা রয়েছে এমন নেতাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিতে হবে। তবেই এ আসনটিতে জয় পাওয়া সম্ভব হবে।
তারা বলেন, ইতঃপূর্বে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী বারবার এ আসনটি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তাই প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হলে এ আসনটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব বলে তারা মনে করছেন।
তারা আরো বলেন, বাঘা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান জামায়াতে ইসলামীর। এ ছাড়া বাঘা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের বেশির ভাগই বিএনপির। অন্য দিকে, চারঘাট উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান বিএনপির এবং ভাইস চেয়ারম্যান জামায়াতে ইসলামীর। এ জন্য তারা মনে করেন, সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া দলের পক্ষ থেকে যাকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হবে সবাই তার পক্ষে কাজ করবেন।
No comments