ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর টার্গেট বাংলাদেশ
এক হাজার ৯২৪ কোটি টাকার ট্যাক্স না দেওয়া ও ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ
রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম
টানা অনিয়ম চলছে বিএটিবির। এমনকি কূটনৈতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে ট্যাক্স না দিতে প্রতিষ্ঠানটি সম্পৃক্ত করেছে বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেককে। বিপুল অঙ্কের রাজস্ব না দিয়ে এ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিগত আট বছরে বিএটিবি ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার করেছে বলে বিভিন্ন মহল সন্দেহ প্রকাশ করেছে। বিএটিবিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক র্যালেই ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের শতকরা ৭২.৯১ ভাগ শেয়ার রয়েছে। অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে ১৪.৫ ভাগ। স্বতন্ত্র বিনিয়োগ ও সরকারি শেয়ার হলো ১.৪৭ ভাগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২০১২-১৩ অর্থবছরের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বিএটিবি ব্রিস্টল ও পাইলট ব্র্যান্ডের সিগারেট দুটিকে কম দামে বাজারজাত করে। এতে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে এক হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এই এক হাজার ৯২৪ কোটি টাকার মধ্যে বিদেশি মালিকানার ৮৭ শতাংশের প্রায় এক হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা বিদেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকেই ব্রিস্টল ও পাইলট ব্র্যান্ডের সিগারেট কম দামে বাজারজাত করে আসছে বিএটিবি। এ হিসেবে বিগত আট বছরে এ খাত থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকারও (প্রতিবছর এক হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা) বেশি পাচার হয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি কোম্পানির এমন অনিয়ম স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশি সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানিটির সামান্য বিনিয়োগের বিপরীতে বিপুল অঙ্কের লাভও এ ব্যবসায় অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করে। যোগাযোগ করা হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কমিশনার মতিউর রহমান বলেন, ‘আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু বিএটিবি উচ্চ আদালতে আপিল করে রেখেছে। তারা নিম্নমানের সিগারেট হিসেবে ব্রিস্টলের অনুমোদন নিয়ে বাজারজাত করে। কিন্তু ল্যাব পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, ডারবি ব্র্যান্ডের উচ্চমানের সিগারেটের সমান মান ছিল এই ব্রিস্টলের। অনৈতিকভাবে বাজার দখল ও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেক বছর ধরেই এই অনিয়ম চলছে বলে অনুমান করা যায়। ’ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘লাভের বিশাল অংশই তারা বিভিন্ন কৌশলে নিয়ে যায়। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে ট্রান্সফার প্রাইসিং, মুনাফা পাচারের বহুল প্রচারিত পদ্ধতি, যেটি করে তৃতীয় বিশ্বের ওপর এভাবেই তারা দাদাগিরি করে। শুধু বিএটিবি নয়, অন্য বহুজাতিক কোম্পানি এটি করে থাকে। বিদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি খাতে দাম বাড়িয়ে মুনাফা কম দেখায়। এভাবে তারা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, কস্ট হিসেবে মুনাফা পাচার করে। অতীতে এ ধরনের অনেক ঘটনা বিভিন্ন দেশে ঘটেছে। তামাক উৎপাদনে কৃষকদের বেআইনিভাবে প্রলুব্ধও করে বিএটিবি। ’ জানা গেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) বিভিন্ন দেশে ঘুষ প্রদান ও ট্যাক্স ফাঁকির আর্থিক কেলেঙ্কারির পর বাংলাদেশেও এ ধরনের অপকর্ম শুরু করে। বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর পক্ষে কথা বলায় স্বাস্থ্য সংগঠনগুলোর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের দাবি, এ আচরণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম ভঙ্গ করেছে। এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হেড অব মিশন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, আদালতের মাধ্যমে নয়, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনায় শুল্ক বিরোধটির সমাধান চেয়েছিলেন অ্যালিসন ব্লেক। আরোপিত কর বিষয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ থাকার কথা নয় বিদেশি রাষ্ট্রদূতের। যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত যা করেছেন সেটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত, অসৌজন্যমূলক এবং আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল। তাদের দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যদি অন্যায় করা হয়, তার এ বিষয়ে প্রতিকার চাওয়ার রেওয়াজ আছে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান অন্যায় এবং অন্যায্যভাবে কর ফাঁকি দিয়েছে, তাদের পক্ষে তিনি কীভাবে লবিং করতে গেলেন!’
ফিরে দেখা : পাকিস্তানের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সে দেশের ব্রিটিশ হাইকমিশনার ফিলিপ বার্টনকে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর পক্ষে লবিং করার বিষয়ে ২০১৫ সালের এপ্রিলে দোষারোপ করেন। তারা ১৩ মার্চের একটি ছবিও প্রকাশ করে, যেটিতে দেখা যায় ফিলিপ বার্টন ইসলামাবাদে এমন একটি সভায় যোগ দেন, যেখানে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল। যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস (এফসিও) এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে তাদের নীতিবিরুদ্ধ মনে করে বলে ওই বছরের ২০ মার্চ পাকিস্তানের ‘দি নেশন’ পত্রিকা খবরও প্রকাশ করে। সাউথইস্ট এশিয়া টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যালায়েন্সের ২৩ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে অবৈধভাবে ২৫ কোটি মালয়েশীয় রিঙ্গিত স্পন্সর করেছিল। ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর যুক্তরাজ্যের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কম শুল্কের ইউরোপীয় অঞ্চলে অধিক পরিমাণে তামাক সরবরাহ করায় প্রতিষ্ঠানটিকে সাড়ে ছয় লাখ ইউরো জরিমানাও গুনতে হয়েছিল। যুক্তরাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তাপুষ্ট আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধান ও যুক্তরাজ্যের প্রথম সারির দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর নানা অনিয়ম উঠে আসে। রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি ও কমোরোস আইল্যান্ডে ২০১৫ সালে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর লবিস্টের মাধ্যমে ২৬ হাজার ডলারের ঘুষ লেনদেনের কথা উল্লেখ করে দক্ষিণ আফ্রিকার মানিওয়েব নামের একটি ওয়েবসাইট। ওই বছর ৩০ নভেম্বর প্রচারিত বিবিসির প্যানোরমা অনুষ্ঠানে দেখানো হয়, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো পূর্ব আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের ঘুষও দিয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ মাসের অনুসন্ধান শেষে বিবিসি জানতে পারে, এ ঘুষ কেলেঙ্কারি যখন প্রকাশিত হয়, তখন কেউ এ-সংক্রান্ত শত শত গোপন নথি প্রকাশ করে দেয়। তখন বিবিসির কাছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর বক্তব্য ছিল, ‘সত্য কথাটি হলো, আমরা বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেব না, সেটি যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন। ’
কেনিয়ায় এ সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে ১৩ বছর কাজ করা পল হপকিন্স বলেন, ‘আমাকে যখন আফ্রিকাতে এটিকে ব্যবসার খরচ হিসেবে উল্লেখ করতে হয়, তখনই আমি ঘুষ দেওয়া শুরু করি। ’ তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো স্থানীয় লোকজনকে ঘুষ দিচ্ছে এবং আমি সে সুযোগ করে দিচ্ছি।
No comments