Breaking News

যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা এক ‘দুঃস্বপ্ন’।


 

আন্তোনিও গুতেরেসমিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা এক ‘দুঃস্বপ্ন’। যে পাঁচ লাখের মতো মানুষ প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তারা যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে, তাতে রক্ত হিম হয়ে আসে। এই নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, আর তা করতে হবে এখনই।


রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জোরের সঙ্গে এই আহ্বান জানান।

নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যও এই প্রশ্নে একমত হয়েছেন যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অব্যাহত সহিংসতা চলছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

গত এক দশকে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা প্রশ্নে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বৈঠকে সমস্যার কোনো আশু সমাধান অর্জিত না হলেও কোন পথে এগোনো প্রয়োজন, সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা ফুটে উঠেছে। এই মুহূর্তে সব পক্ষই মতৈক্যের ভিত্তিতে কূটনৈতিক পথে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন। শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো অথবা কোনো রকমের শাস্তিমূলক ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপের প্রস্তাব ওঠেনি বৈঠকে।

যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত জনাথন গাই এলেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি আঙুল তুলে বলেন, এই সহিংসতা তাদের সৃষ্টি, এর সমাধানও তাদেরই করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হেইলি বলেন, একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূলের যে চেষ্টা চলছে, মিয়ানমারের সরকার বা জনগণ কেউই সে জন্য গৌরববোধ করতে পারে না।

এমনকি চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতেরাও অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন।
তবে নিরাপত্তা পরিষদের এই দুই স্থায়ী সদস্য সেনাবাহিনীর কার্যকলাপকে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে পরিচালিত বলে ব্যাখ্যা করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গান। চীনের রাষ্ট্রদূত উ হাইতাও এমন দাবিও করেন, কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
রুশ রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া আরও এক ধাপ এগিয়ে চলতি সহিংসতার সব দায়ভার চাপান রোহিঙ্গা লিবারেশন আর্মি বা আরসার ওপর। তিনি দাবি করেন, এই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে বেসামরিক নারী-পুরুষ নিহত হয়েছে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতিকে ‘জাতিহত্যা’ বা জেনোসাইড অথবা জাতি নির্মূলকরণ বা এথনিক ক্লিনজিং নামে অভিহিত করার বিরুদ্ধেও তিনি সতর্কতা উচ্চারণ করেন।
একাধিক দেশের কূটনীতিকেরা রাশিয়ার এই কঠোর অবস্থানে বিস্ময় প্রকাশ করেন। একজন বাংলাদেশি কূটনীতিক তাঁর হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, নিজ দেশে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বিদ্রোহ নিয়ে রাশিয়া ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। সে কারণেই তাকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অভিন্ন অভিমতের বিপরীতে অবস্থান নিতে হয়েছে। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
পরিষদের সদস্যরা সবাই একমত যে রাখাইন রাজ্যে উপদ্রুত এলাকায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাকে কোনো বাধা ছাড়া প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটি একটি মানবিক বিপর্যয়, জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা রাখাইন রাজ্যে দ্রুত সাহায্য পৌঁছে দিতে বর্মি কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্যের আবেদন করলেও ইয়াঙ্গুন থেকে কোনো সদুত্তর পায়নি। মহাসচিব দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বারবার আবেদন সত্ত্বেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ‘এখন (সাহায্য সংস্থাসমূহকে) আসতে দেওয়া যাবে না’ বলে জানিয়েছে। মানবাধিকার পরিষদ একটি তথ্যানুসন্ধানী দল প্রেরণ করতে আগ্রহী, বর্মি কর্তৃপক্ষ তাতেও আপত্তি জানিয়েছে। মহাসচিব বলেন, সমস্যার গভীরতা বিবেচনা করলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এই অবস্থান ‘খুবই দুঃখজনক’। তবে বাংলাদেশ উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে যে উদারতা দেখিয়েছে, মহাসচিব তার প্রশংসা করেন। তিনি জানান, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সাহায্যের লক্ষ্যে আগামী ৯ অক্টোবর দাতাদেশগুলোর একটি সম্মেলন ডাকা হয়েছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব জোর দিয়ে বলেন, সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সব শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে। এই প্রস্তাবে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের রাষ্ট্রদূতেরা বলেন, যারা স্বেচ্ছায় ফিরে আসতে চায়, কোনো বাধা ছাড়া তাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। সুইডেনের রাষ্ট্রদূত ওলফ স্কুগ আরও বলেন, শুধু সহিংসতা বন্ধ হলে ও মানবিক সাহায্য আসতে দিলেই এই সংকটের সমাধান হবে না। এর জন্য প্রয়োজন পড়বে শরণার্থী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে এমন প্রত্যেক রোহিঙ্গা যাতে ‘নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও সম্মানের সঙ্গে’ ফিরতে পারে, তা নিশ্চিত করা। কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে এই রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হলে এই কমিশনের প্রস্তাবমাফিক সব রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। মহাসচিবসহ পরিষদের অধিকাংশ সদস্য কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে যে পাঁচ প্রস্তাব করেছেন, তাতেও এই কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়েছে।

চতুর্থত, পরিষদের সদস্যদের মতে, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের জন্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশ, এই দুই প্রতিবেশী দেশকেই সমঝোতার ভিত্তিতে একযোগে কাজ করতে হবে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া এই প্রশ্নে অগ্রগতি সম্ভব হবে না। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ১৯৯৩ সালে এই দুই দেশের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়, তা একটি সহায়ক পথনির্দেশ হতে পারে, কিন্তু তাতে সমস্যা মিটবে না। কারণ, এই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়নি। মহাসচিব মনে করেন, উন্মূল এসব মানুষ যে সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, তার কারণই হলো তাদের নাগরিকত্বহীনতা।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী রয়েছে, এই প্রসঙ্গ একাধিক রাষ্ট্রদূতের ভাষণেই উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেন, আরসার হাতে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তাঁর দেশ সেসব ঘটনার নিন্দা করে। কিন্তু তার জবাবে বর্মি সেনাবাহিনী যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা মোটেই আনুপাতিক নয়। মিসরের রাষ্ট্রদূত আরও স্পষ্ট করে বলেন, অব্যাহত নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধে অংশ নেওয়া ছাড়া আর কি কোনো পথ খোলা আছে?
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দাবি করে এসেছে, তার সেনাবাহিনীর অভিযানের লক্ষ্য রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বর্মি রাষ্ট্রদূত সেই অভিযোগ পুনরুল্লেখ করে বলেন, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির আক্রমণের জবাবেই সেনাবাহিনীকে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, রাখাইন রাজ্যে সমস্যা আছে, কিন্তু সেখানে কোনো গণহত্যা হয়নি, জাতিগত নির্মূলের মতো কিছু ঘটেনি। অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য আগামী সোমবার বিদেশি কূটনীতিক ও তথ্যমাধ্যমের প্রতিনিধিদের রাখাইন রাজ্যে সফরের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন জানান, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রশ্নে তাঁর দেশ ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি অনুসরণ করে থাকে। রোহিঙ্গাদের ভেতরে যদি কোনো সন্ত্রাসী থেকে থাকে, তাদের খুঁজে বের করতে বর্মি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথ অভিযানে বাংলাদেশ প্রস্তুত। তিনি জানান, বর্মি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন উসকানির মুখেও বাংলাদেশ সংযমের পরিচয় দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী বলে যে প্রচারণা মিয়ানমার চালাচ্ছে, রাষ্ট্রদূত মাসুদ তাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করে বলেন, ‘এই প্রচারণা থামাতে হবে।’
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানে বাংলাদেশ যে উদারতার পরিচয় দিয়েছে, প্রায় সব বক্তাই তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। জাতিসংঘে সুইডিশ মিশনের একজন মুখপাত্র প্রথম আলোকে জানান, রাষ্ট্রদূত ওলফ স্কুগ তাঁর বক্তব্যে আলাদাভাবে বাংলাদেশের ভূমিকা চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশের মানবিক সাহায্যক্ষমতা যাতে বৃদ্ধি পায়, সে লক্ষ্যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সমর্থনে সুইডেন অতিরিক্ত ত্রাণ পাঠিয়েছে বলেও তিনি জানান।
আপাতভাবে নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠক থেকে স্পষ্ট কোনো উদ্যোগ প্রকাশিত না হলেও ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রশ্নটি কোন পথে এগোয়, তার কিছু লক্ষণ মিলেছে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই সমস্যা সমাধান করতে হলে জাতিসংঘকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করলেও এই প্রশ্নে আন্তর্জাতিক জনমত খুবই স্পষ্ট। রাষ্ট্রদূত মাইলামের মতে, বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করা মিয়ানমারের পক্ষে কঠিন হবে। ‘রোহিঙ্গা প্রশ্নে বিশ্ব বাংলাদেশের পাশে আছে’, রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন।
একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হেইলি তাঁর বক্তব্যে বর্মি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো রকমের সহযোগিতার বিরোধিতা করেন। উড্রো উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ, তবে নিরাপত্তা পরিষদ যদি তেমন কোনো প্রস্তাব গ্রহণের চেষ্টা করে, তাহলে চীন হয়তো তার বিরোধিতা করবে। পরিষদের উন্মুক্ত বৈঠকের বিষয়ে কুগেলম্যান বলেন, এর ফলে অন্য আর কিছু না হোক, রোহিঙ্গা প্রশ্নে বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষিত হলো। দুর্ভাগা এই জনগোষ্ঠীর এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা হলো সহিংসতা বন্ধ করা ও সর্বাত্মক মানবিক সাহায্য দ্রুত উদ্বাস্তুদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সেই প্রশ্নে বিশ্ববাসী একমত।
রাষ্ট্রদূত মাসুদও মনে করেন, এই বৈঠকের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ববাসী তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে। এর ফলে সংকট নিরসনে উদ্যোগী হতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ল। মহাসচিব ও পরিষদের সদস্যরা পরবর্তী পদক্ষেপের একটি ‘মডালিটি’ বা কাঠামো দিয়েছেন, বাংলাদেশ তাকে সমর্থন করে। তিনি বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে এগোতে হবে, কিন্তু বিশ্ববাসী বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের পাশে আছে, নিরাপত্তা পরিষদ থেকে পাওয়া এই বার্তা আমাদের জন্য অবশ্যই স্বস্তির বিষয়।’

No comments