ভ্রমণ: চন্দ্রগিরি: যেখানে মেঘ ছোঁয়া যায়
এখানে
যে এত ঠান্ডা তা কে জানত! জানলে গরম কাপড় অবশ্যই আনতাম। বাংলাদেশে এখন
ভাদ্রের তালপাকা গরম। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে তেমনটি নেই বটে। তবে যে
গরম আছে, তা তাতিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ঢাকার মতো যানজট আছে, রাস্তার হাল আরও খারাপ কাঠমান্ডুর। দিনভর বেশ তাপ। তবে শেষরাতে গা কিছুটা শিন শিন করে। কিন্তু চন্দ্রগিরিতে এসে তো রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় সাড়ে আট হাজার ফুট। কাঁপুনি তো ধরবেই। এত উঁচু পাহাড়ে উঠে আসার পথটাও রোমাঞ্চকর।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির একটি প্রকল্প দেখতে আমরা সাংবাদিকদের একটি দল গিয়েছিলাম নেপালে। সেখানে কাজের ফাঁকে এই চন্দ্রগিরি অভিযান। যাওয়ার পথে কাঠমান্ডু ছাড়ার সময় বড় বড় যানজটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। ঘেমে উঠছি বারবার। তখনই গাড়ির নেপালি চালক দেবেন্দ্র বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন। ঠান্ডায় কাঁপবেন।’ কাঠমান্ডু শহর থেকে দেড় ঘণ্টার পথ চন্দ্রগিরি। সেখানেই এত শীত হবে! ঠিক বিশ্বাস হলো না।
মেঘ-পাহাড়ের দেশে এসে অনেকরই আবদার ছিল মেঘ ছোঁয়ার। স্বল্প সময়ে এভারেস্টের কাছে যাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত নেই। তবে আয়োজক প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির প্রধান সঞ্চালন কর্মকর্তা (সিওও) গৌতম ভট্টাচার্য বললেন, ‘মেঘের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে যাদের উচ্চতাভীতি আছে, তাঁরা কিন্তু যাবেন না।’ তবে সেই ভয়ে ভীত হওয়ার একজনও মিলল না। সবাই মিলে চন্দ্রগিরির পথ ধরলাম। কাঠমান্ডু মূলত একটি উপত্যকা। এর চারপাশ ঘিরে আছে পাহাড়। প্রায় দুই ঘণ্টা মাইক্রোবাসে চেপে নামলাম থানকোট। সেখান থেকে শুরু হলো পাহাড়ি পথ। এরপর পাহাড় কেটে তৈরি শক্ত কংক্রিটের সুদৃশ্য পথ এঁকেবেঁকে গিয়ে থামল চন্দ্রগিরি কেব্ল কার স্টেশনে। বিশাল এই এলাকা থেকে নিচের থানকোট শহর স্পষ্ট। একটি পাহাড় ডিঙিয়ে কাঠমান্ডু। সেটা খুব একটা স্পষ্ট না।
কেব্ল কারের স্টেশনে আছে সুদৃশ্য ফোয়ারা। ছোট কয়েকটি রেস্তোরাঁ। সিঁড়ি বেয়ে উঁচু একটি ভবনে উঠে কেবল কারের মূল স্টেশনে পৌঁছালাম। এর আগে টিকিট কাটতে হলো। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মাথাপিছু টিকিট ১ হাজার ১০০ নেপালি রুপি। তার বেয়ে লাল রঙের কারগুলো স্টেশনে আসছে। গতি একটু কমতেই সেখানে চড়ে বসলাম। একটি গিয়েই শুরু হলো পাহাড়ি পথ। দিনটা ছিল বেশ মেঘলা।
কার ছাড়ার আগেই গৌতম ভট্টাচার্যের সাবধানবাণী, ‘যারা ভয় পান, তারা উল্টো দিকে বসুন।’
কারের দুই পাশে মুখোমুখি ছয়জন। যাঁরা নিচের দৃশ্য দেখতে চান না, তাঁরা উল্টো দিকে বসলেন। সরসর করে উঠছে কেব্ল কার। যত ওপরে উঠছি, নিচের শহর তত ছোট হয়ে যাচ্ছে। নিচে ঘন সবুজ বন কালচে হচ্ছে। খানিকটা উঠেছি, এরই মধ্যে কোত্থেকে এক দল মেঘ এসে লাগল কারে, গায়ে। ভিজিয়ে দিয়ে গেল গ্লাস। মেঘের ছোঁয়ায় বিন্দু বিন্দু জলকণা জমে আছে সেখানে। আমাদের গায়ে লাগল হিমেল পরশ। একটু ঠান্ডা লাগছে। কেব্ল কারের যাত্রীদের মধ্যে এখন শুধু ‘ওয়াহ’ ‘কী সুন্দর’ ‘বাহ’ ধনি। মাঝেমধ্যে একটি দুটি কারের চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কিছু দূর উঠে নিচে শুধু মেঘের খেলা চোখে পড়ল। এখন বনও অদৃশ্য। কালচে মেঘের চাদর ঢেকে দিয়েছে সবুজ। ঠান্ডা আরও বাড়ছে। মেঘের খেলা দেখতে দেখতে, ভয়মিশ্রিত তীব্র ভালো লাগায় ভাসতে ভাসতে, অনেক ভাসা মেঘের পরশ গায়ে মেখে তারের ওপর দিয়ে চলা আমাদের ছোট গাড়িটি গিয়ে থামল চন্দ্রগিরি স্টেশনে। আড়াই কিলোমিটারের কেবল কার ভ্রমণ শেষ হলো।
পাহাড়ের খাঁজে গোলাকৃতি স্টেশন। সেখানে কিছুক্ষণ চলল ছবি তোলার ধুম। আজ মেঘলা দিন হলেও লোক কম নেই। নেপালের বাসিন্দা মেঘলা রাজ্ঞী বললেন, ‘গেল বছর কেবল কার চালু হওয়ার পর চন্দ্রগিরি একটা আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। দিন ভালো থাকলে দেখতেন ঢল নেমেছে।’
আমরা কিন্তু এতক্ষণে পাহাড় শীর্ষে উঠিনি। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় আছে ভালেশ্বর শিবমন্দির। এবার হাঁটা পথ। পাহাড়ের কংক্রিটের এই রাস্তাটি ঝকঝকে। কুটোটি পড়ে নেই। রাস্তার পাশ লোহার দণ্ড দিয়ে ঘেরা। চন্দ্রগিরির শীর্ষে কারুকার্যমণ্ডিত অপূর্ব শিবমন্দির। লালচে রঙের এ মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন এখানে আসা অনেকেই। ধূপ, ধুনো, মোমবাতির সমাবেশে এক ভিন্ন আবহ, পাহাড়ের মতোই গম্ভীর। মন্দিরের একেবারে উল্টো দিকে সুদৃশ্য রেস্তোরাঁ। মন্দিরের বারান্দায় বিশাল আকৃতির পিতলের গরু, শিবের বাহন। এ ছাড়া আছে কয়েকটি সিংহ, পিতলেরই। চারপাশের পরিবেশ দেখে আমাদের সঙ্গে থাকা চ্যানেল আইয়ের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সৌমিক আহমেদ বলছিলেন, ‘পর্যটনশিল্প কাকে বলে তা এঁরা জানে।’
আমাদেরও পাহাড়ি জনপদ আছে। সেখানে এত উঁচুতে না হলেও কেব্ল কারের ব্যবস্থা করার মতো পাহাড়ি পথ আছে। সেসব নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা চলল কিছুক্ষণ।
রেস্তোরাঁর দোতলায় গিয়ে আর উঁচু থেকে দেখা গেল চারপাশ। দেখা গেল বলতে অন্ধকার মেঘরাজ্যের দেখা পাওয়া গেল। আর ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকল তীব্র শীত। কাঁপতে লাগলাম রীতিমতো। গরম কাপড় কেন আনিনি, এর জন্য নিজেকেই কিছুটা দায়ী করলাম। এ ঠান্ডা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে টাইগার আইটির প্রকৌশলী সঞ্জয় রাহার পরামর্শ বেশ কাজে লাগল। গরম লেবুপানিতে মধু মিশিয়ে অর্ডার দিলাম রেস্তোরাঁয়। এ পানি পানে শরীর বেশ খানিকটা উষ্ণ হলো।
একটি নয়, দুটি নয়, তিনটি রেস্তোরাঁ এখানে। আছে নিরামিষ-আমিষের ভিন্ন ব্যবস্থা। কেউ অর্ডার দিলে সামনাসামনি রান্না করে দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে। এখানে এখন তৈরি হচ্ছে একটি রিসোর্ট। আছে শিশুদের ছোট পার্ক, ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ি পথে চলার ব্যবস্থা।
মাঝে একটু আলোর ঝলকানির পর মেঘ আবার রাজ্য দখল করে ফেলল। আমরা এই চন্দ্রগিরির একটি রেস্তোরাঁয় সারলাম দুপুরের আহার। শহর কাঠমান্ডুতে রেস্তোরাঁয় যা পাওয়া যায়, এর প্রায় সবকিছু উপস্থিত এখানেও।
বেলা গড়িয়ে এল। এবার নামতে হবে। আবার কেব্ল কারের স্টেশনে গিয়ে চড়লাম কারে। এবার ভয় খানিকটা কমে গেছে। আবারও বিস্ময়, আনন্দ, মেঘ ছোঁয়ার আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম।
যাঁরা যেতে চান চন্দ্রগিরি, তাঁদের জন্য কিছু তথ্য: সপ্তাহের সাত দিনই যাওয়া যায় চন্দ্রগিরি। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে প্রতি কর্মদিবসে কেব্ল কার চলে। ছুটির দিন চলে সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। ভাড়া প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১ হাজার ১০০ নেপালি রুপি। তিন ফুটের নিচে উচ্চতার শিশুদের কোনো ভাড়া দিতে হবে না। তিন থেকে চার ফুট উচ্চতার শিশুরা ৪০ শতাংশ কম ভাড়ায় ভ্রমণ করত পারবে।
১১ বছরের কম বয়সীদের সঙ্গে অবশ্যই ১৫ বছর বা এর বেশি বয়সী কাউকে থাকতেই হবে।
আর হ্যাঁ, ভর গরমে গেলেও যাঁদের আমার মতো ঠান্ডার ধাত আছে, তাঁরা গরম পোশাক নিতে ভুলবেন না।
No comments