ত্রাণ দিয়ে ফেরার পথে প্রাণ গেল সিলেটের পাঁচ ব্যবসায়ীসহ ৬ জনের
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, সকালে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। ব্যবসায়ীদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকা কান্দাইলে পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই মাইক্রোবাস চালকসহ চারজন নিহত হন। আহত ৪ জনকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নেয়ার পর আরও ২ জনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার পর মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সড়কের দুই পাশে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে লাশ উদ্ধার করে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি সরিয়ে নিলে দেড় ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
নিহতরা হলেন- বিয়ানীবাজার পৌর শহরের জামান প্লাজার রূপসী বস্ত্র বিতানের মালিক মাথিউরা পূর্বপাড় এলাকার মৃত লুৎফুর রহমানের ছেলে রেজাউল করিম (৩৪), শখ কসমেটিকসের মালিক মুড়িয়া ইউনিয়নের ছোটদেশ গ্রামের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাজিদ খানের ছেলে খায়রুল বাশার খয়ের (৪২), মতিন ক্লথ স্টোরের পরিচালক পৌরসভার শ্রীধরা গ্রামের ময়না মিয়ার ছেলে জোবের আহমদ (৩০), মরটিন কয়েলের বিয়ানীবাজারের ডিলার শেওলা ইউনিয়নের কাকরদিয়া গ্রামের নাজিম উদ্দিনের ছেলে ইকবাল আহমদ (২৮), কলেজ রোডের জি-ফোন সেন্টারের কর্মকর্তা কসবা গ্রামের আরজিদ আলীর ছেলে বাবুল আহমদ (৩৩) এবং মাইক্রোবাস চালক কসবা গ্রামের মুসলিম আলীর ছেলে বাবুল আহমদ (৩৫)।
এছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন কাপড় ব্যবসায়ী মাথিউরা সুতারকান্দির দেলোয়ার হোসেন ও হাফিজুর রহমান। তাদের নরসিংদী সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।
ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী আনিসুল বলেন, প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিল। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে দেখি একটি মাইক্রোবাস দুমড়ে- মুচড়ে রাস্তার এক পাশে পড়ে আছে। পরে পুলিশকে খবর দেয়া হয়।
নরসিংদী ফায়ার সার্ভিস উপসহকারী পরিচালক মজিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, মাইক্রোবাসের চাকা বিস্ফোরণ হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মাধবদী থানা উপ-পরিদর্শক উত্তম কুমার বিশ্বাস বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি গাড়ির একপাশ ছিঁড়ে গেছে। ভেতরে ৩টি লাশ ও বাইরে একটি লাশ পড়ে আছে।
নিহতদের বাড়িতে শোকের মাতম : বিকালে নরসিংদী সদর হাসপাতাল থেকে নিহত ব্যবসায়ীদের লাশ নিয়ে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হন স্বজনরা। এর মধ্যে তাদের বাড়িতে নেমে আসে শোকের ছায়া। বিয়ানীবাজার উপজেলায় নিহত ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা আম্বিয়া বেগম হাউমাউ করে বিলাপ করছেন। বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমি শুঁটকি পছন্দ করি তাই রেজা উখিয়া থেকে অনেক জাতের শুঁটকি কিনেছে। রাতে ফোনে বলেছে, মা তোমার জন্য অনেক শুঁটকি কিনেছি। একটু পর রওনা হব। আমার বুকের ধনকে ফিরিয়ে দাও, আমি আর কিছু চাই না। খবর শুনে স্বামীর বাড়ি থেকে পাগলের মতো ছুটে এসেছেন রেজাউলের দুই বোন। তার স্ত্রী স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকেই অজ্ঞান। স্বজনরা তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন।
নিহত ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেনের মা সুফিয়া বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, আমারে কইয়া (বলে) গেছে সোমবারে আইবো (আসবে)। এখন কেনে আমার পুয়া (ছেলে) আয় না। অসহায় মানুষরে সাহায্য করতে গিয়া আমার পুয়া মরল কেনে গো।
নিহত ব্যবসায়ী খায়রুল বাশার খান খয়েরের বাড়িতেও বইছে শোকের মাতম। শিগগিরই পারিবারিকভাবে তার যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল। তার অবুঝ দুই ছেলে বাবার জন্য কাঁদছে। শিশুদের কান্না দেখে উপস্থিত স্বজনরা চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন। আহত ব্যবসায়ী দেলওয়ার হোসেন যুগান্তরকে জানান, বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগামী একটি বাস ওভারটেক করতে গিয়ে তাদের বহনকারী গাড়িকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। মাইক্রোবাসের ডান পাশে থাকা ব্যবসায়ীরা নিহত হয়েছেন।
পৌর মেয়র আবদুস শুকুর জানান, নিহতদের জানাজা আজ সকাল ১০টায় বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ মাঠে হবে।
শোক : পাঁচ ব্যবসায়ীসহ ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, জাতীয় পার্টির এমপি জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় হুইপ সেলিম উদ্দিন আহমদ ও জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
অপর দুর্ঘটনায় ৩ জনের মৃত্যু : এদিকে সকাল ১০টার দিকে একই মহাসড়কের নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার কারারচর বিসিক শিল্পনগরী এলাকার মদিনা জুট মিলের সামনে আরেকটি দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। ঢাকা থেকে সিলেটগামী দিগন্ত পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে নরসিংদী থেকে ইটাখোলাগামী লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে একজন নিহত হয়। আহত অবস্থায় ৬ জনকে জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দু’জনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন- শিবপুরের কারারচর গ্রামের আরমান মিয়া (৫০), সৈয়দনগর গ্রামের মাসুম মিল্লাহ ও সুজন মিয়া (২৫)।
ইটাখোলা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর হাফিজুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি দুটি জব্দ করা হয়েছে। বৃষ্টিতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
Post Comment
No comments