Breaking News

অপরাধী ধরতে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিল পুলিশ

মির্জা মেহেদী তমাল

অপরাধী ধরতে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিল পুলিশ
দেশের একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীকে নিয়ে পুলিশের ভিতর অস্থিরতা চলছে। সদর দফতরে পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে চলছে বৈঠকের পর বৈঠক।

যে কোনো উপায়ে ধরতেই হবে সেই অপরাধীকে। সদর দফতরের বৈঠকগুলোয় পুলিশপ্রধান সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেন কর্মকর্তাদের কাছে। তিনি পদস্থ কর্মকর্তাদের বলেন, ‘যে কোনোভাবেই হোক, তাকে হাজির করতে হবে। আর এজন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই দেওয়া হবে পুলিশকে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। ’ পুলিশপ্রধানের বক্তব্যে বৈঠকে কর্মকর্তাদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একজন দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই কিছু দিন আগেও প্রকাশ্যে বুক চিতিয়ে সদলবলে চলাফেরা করেছে এই অপরাধী। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের পাশে দেখা গেছে। এক মঞ্চে মন্ত্রীর বক্তব্যের আগে এই অপরাধীকেও বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। সরকারের ক্যাডার হিসেবে চিহ্নিত এই অপরাধীকে পাকড়াওয়ে আবার রোষানলে পড়তে হবে কিনা, তা পরিষ্কার হওয়া উচিত। ’ পুলিশপ্রধান তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘সরকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এই অপরাধীর দিক থেকে। তাই এখনই সময়, তাকে পাকড়াওয়ের। ’ পুলিশপ্রধানের এমন বক্তব্যে কর্মকর্তারা খুশি। কিন্তু কোথায় পাবে সেই অপরাধীকে? তাকে ধরতে সারা দেশে পুলিশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। তবু খোঁজ মিলছে না ঘুম হারাম করে দেওয়া সেই অপরাধীর। পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েক দিন। মেলেনি সেই অপরাধীর খোঁজ। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান ব্যর্থ হয়ে গেছে। আগেভাগেই তথ্য পেয়ে যাচ্ছে সেই অপরাধী। পুলিশ পৌঁছার আগেই সে হাওয়া। সকাল থেকেই সদর দফতরে থমথমে অবস্থা। অপরাধী গ্রেফতার হয়নি। সরকারের শীর্ষ পর্যায় এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে পুলিশপ্রধানকে এ নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে। এসব নিয়ে সদর দফতরে জরুরি বৈঠক চলছে। পুলিশপ্রধান তার ক্ষোভ ধরে রাখতে পারছেন না। ঢাকা জেলার এসপিসহ অন্য জেলার এসপিরা বৈঠকে সেদিন কথা বলতে পারছেন না। পুলিশপ্রধান একাই বলে যাচ্ছেন। দুপুরের পর শুরু হওয়া বৈঠক বিকাল পর্যন্ত গড়ায়। হঠাৎ একটা মেসেজ পেয়ে বৈঠক থেকে উঠে যান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আল ফরিদ। ফিরে এসে তিনি পুলিশপ্রধানের কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বললেন। পুলিশপ্রধানের চেহারা পাল্টে যায়। চোখ স্থির। তিনি হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘ওকে, নো প্রবলেম। আমরা আমাদের কাজ করে যাব। ’ এরপর ঢাকা জেলার এসপি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা আমাদের লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছাতে যা দরকার, তার সবটাই করব। ’ বৈঠক শেষ করে আবারও ছোট বৈঠকে বসেন পুলিশপ্রধান। এবার ঢাকার এসপি ও ঢাকার পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে। তারা প্রত্যেকেই উত্তেজনায় কাঁপছেন। কারণ সেই অপরাধীর সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু যেখানটায় সেই অপরাধী আছে, সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসা বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষে দুরূহ। তবু পুলিশ সেখান থেকে তাকে বের করে আনতে বদ্ধপরিকর। আর এজন্য রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়োজন পড়বে। পুলিশের প্রস্তুতি সে পথেই এগোচ্ছে। ১৯৮২ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। কাক-ভোর থেকেই রাজধানীর মিন্টো রোড মন্ত্রিপাড়ায় বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ। মন্ত্রী ও বিচারপতিদের সরকারি বাসভবনের ছাদ, গ্যারেজ, আঙিনায় তাদের অবস্থান। অস্ত্র তাক করে আছেন তারা। তাদের নিশানায় মিন্টো রোডের ৪০ নম্বর বাড়ি। বাড়িটি যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন। মন্ত্রীর বাড়ির সীমানাপ্রাচীরেও পুলিশ উঠে ভিতরের দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। তারা গুলি চালাতে প্রস্তুত। শুধু নির্দেশের অপেক্ষা। হ্যান্ডমাইকে পুলিশের অনবরত ঘোষণা— ‘পুরো বাড়ি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। কোনোরকম চালাকি না করে সারেন্ডার করুন, নইলে পুলিশ ভিতরে ঢুকে পড়বে। ’ কিন্তু কোনো সাড়া নেই। পুলিশ প্রস্তুতি নিল ভিতরে ঢোকার। এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে মন্ত্রীর বাসভবনে অভিযানের অনুমতি নিল পুলিশ। পুরো ঘটনার নেতৃত্বে তত্কালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার এ এফ এম মাহমুদ আল ফরিদ। সকাল ১০টা থেকে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি বেড়ে যায়। ওয়াকিটকিও তাদের ভীষণ ব্যস্ত। শীতের সকালেও দরদর করে ঘামছেন কর্মকর্তারা। একজন মন্ত্রীর বাসভবন ঘিরে কয়েক শ পুলিশের এই যুদ্ধংদেহী অবস্থানে গোটা শহরে তখন অজানা আতঙ্ক। মিন্টো রোডে সাধারণের যান চলাচল বন্ধ। আশপাশ এলাকায় উত্সুক মানুষের ভিড়। দুপুরে একদল সশস্ত্র পুলিশ মন্ত্রীর বাসভবনের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ মন্ত্রীর বাড়ির মূল ফটকের পকেট দরজা খুলে যায়। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে একজন! ধীর পায়ে। চাদর গায়ে, মুখ অর্ধেক ঢাকা। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। সুনসান নীরবতা। পুলিশের অস্ত্রের নল ঘুরে যাচ্ছে লোকটির দিকে। হেঁটে লোকটি পুলিশের একদম কাছাকাছি। পুলিশ সদস্যরা তাকে ঘিরে ফেললেন। লোকটি দুই হাত উঁচু করে দাঁড়াল। পুলিশ তাকে জাপটে ধরে। লোকটির দুই হাত পেছন দিকে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে তাদের ভ্যানে তুলে নেয়। পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখে তখন হাসি। ভ্যানটি চলতে শুরু করল। পুলিশের গাড়ির বহর ভ্যানকে অনুসরণ করল। উত্সুক জনতার উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে পুলিশ বলে, ‘আমাদের অভিযান শেষ। দেশের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধী এখন আমাদের কব্জায়। ’ দুর্ধর্ষ সেই লোকটি ২২ খুনসহ অসংখ্য গুম ও ডাকাতি মামলার আসামি এমদাদুল হক ইমদু। ইমদু নামেই যিনি বেশি পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্ধর্ষ যে কজন অপরাধীর নাম বলা হয়, তাদের অন্যতম এই ইমদু; যার নৃশংসতা মনে পড়লে মানুষ এখনো আঁতকে ওঠে। এই ভয়ঙ্কর অপরাধীকে গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তিন দিন ধরে তত্কালীন যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসভবন ঘিরে রাখতে হয়েছিল। সংশ্লিষ্টদের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশে ইমদুই একমাত্র সন্ত্রাসী যাকে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই ইমদু একসময় দানবে পরিণত হয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ ডন। ইমদুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং পুলিশের তত্কালীন কয়েকজন কর্মকর্তার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) সঙ্গে কথা বলে তার নাটকীয় গ্রেফতার সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের দেওয়া তথ্যে উঠে এসেছে ইমদুর অপরাধ জীবনের নানা চাঞ্চল্যকর ও ভয়ঙ্কর সব কাহিনী। ইমদুর মতো একজন অপরাধীকে গ্রেফতারে রাষ্ট্রপতির অনুমতি পর্যন্ত নিতে হয়েছিল। কারণ ইমদু লুকিয়ে ছিলেন মন্ত্রীর বাসভবনে। মন্ত্রীর বাধার মুখে পুলিশ সেই বাসার চারদিকে অবস্থান নিয়ে ছিল তিন দিন। ইমদু এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন, মানুষ তার নাম উচ্চারণ করত সন্ত্রাস, অপহরণ আর হত্যার প্রতীক হিসেবে। যার শুরু কালিগঞ্জ উপজেলার সাতানিপাড়া গ্রামে, আর সমাপ্তি কারাপ্রাচীরের আড়ালে ফাঁসির দড়িতে। ১৯৭৭ থেকে ’৮২ সাল। এই পাঁচ বছরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন ইমদু। আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে রাজনীতি অস্থির থাকত তার নামে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘুম হারাম করে দেওয়া এই দুর্ধর্ষ অপরাধী দিনদুপুরে মানুষ খুনে ছিলেন পারদর্শী। প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যদের হত্যা করে বাঁশে ঝুলিয়ে রাখার মতো রোমহর্ষক ঘটনাও তিনি ঘটিয়েছেন। তার অপরাধের প্রতিবাদকারীদেরও প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছেন তিনি। পুলিশও রেহাই পায়নি। হত্যা করে লুটে নিয়েছেন অস্ত্র। শিশু ও নারীরাও তার শিকার হয়েছে। কালিগঞ্জের বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন করেছেন তিনি। অনেকেই তার ভয়ে ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন। পাইকারি হারে খুন করলেও ইমদু নিজে অসংখ্যবার মৃত্যু থেকে রক্ষা পান অলৌকিকভাবে। প্রতিপক্ষরা অ্যামবুশ করে গুলি চালিয়েও তাকে হত্যা করতে পারেনি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার এমন বহু গল্প রয়েছে ইমদুর ঘটনাবহুল অপরাধ জীবনে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যেতেন তিনি। একদিকে তিনি খুন করে বেড়াতেন, অন্যদিকে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সে খবর দেখানো হতো টিভিতে, প্রকাশ পেত পত্রপত্রিকায়। যে কারণে পুলিশও তাকে ঘাঁটাত না। তবে মন্ত্রীর বাসভবন থেকে গ্রেফতারের ঘটনাটি ছিল তার জীবনের শেষ গ্রেফতারের ঘটনা। যত দিন বেঁচে ছিলেন কনডেম সেলের পাথর দেয়ালের মধ্যেই তাকে থাকতে হয়েছে। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়, যা কার্যকর হয় গ্রেফতারের ওই বছরই।
কে এই ইমদু : কালিগঞ্জের সাতানিপাড়া গ্রামের কৃষক আশরাফ আলীর ছেলে এমদাদুল হক ইমদু। সাতানিপাড়া খৈ কোরা হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। স্বাধীনতার পর ইমদু জাসদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কালিগঞ্জের জাসদ নেতা আলী হোসেন তালুকদারের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও তাদের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হয় একটি ডাকাতি করে পাওয়া মাল ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। এর জেরে জাসদ সেখানে দুই ভাগ হয়ে পড়ে। কালিগঞ্জের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের দক্ষিণ পাশের নেতৃত্ব আলী হোসেনের এবং উত্তর পাশ ইমদুর নেতৃত্বে। তাদের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে, তার শেষ ঘটে খুনোখুনির মধ্য দিয়ে। শুরু হয় উভয় গ্রুপের মধ্যে খুন-পাল্টা খুন।
ভয়ঙ্কর ইমদু : জাসদ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর ইমদু বিএনপিতে যোগদান করেন। তত্কালীন যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের হাত ধরে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন ১৯৮০ সালে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি দানবে রূপ নেন। শুরু হয় তার ‘জাসদ খতম’ মিশন। জয়দেবপুর উপজেলার খিলগাঁও গ্রামের বাবুল, আবদুল কাদের ভূইয়া, কফিলউদ্দিন সামসুকে নিজ হাতে খুন করেন। এরা প্রত্যেকেই তার একসময়ের সহযোগী ছিলেন।

No comments