সাদারাও সন্ত্রাসী : তসলিমা নাসরিন
তসলিমা নাসরিন:
ভিড়ের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কুপিয়ে মারা হয়েছে কাউকে।
বোমা মারা হলো কোনও বাসে বা বিল্ডিংয়ে, কোনও মার্কেটে বা মসজিদে। আমরা ধরে নিই, এটি ইসলামিক কোনও দলের কর্ম। লাস ভেগাসের কনসার্টে গুলির বৃষ্টি ঝরিয়ে যে স্টিফেন প্যাডক নামের এক লোক ৫৯ জন নিরীহ মানুষকে খুন করেছে, ৫২৭ নিরীহ মানুষকে আহত করেছে... সে লোক কিন্তু মুসলিম নয়। তার গায়ের রঙ কালো বা বাদামি নয়। তার গায়ের রঙ সাদা। ধর্ম, রাজনীতি, হিংসে, বিদ্বেষ— এসবের মধ্যেই নেই সে। তারপরও স্টিফেন খুন করেছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। স্টিফেন প্যাডক কোটিপতি। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা আছে তার। জুয়োর নেশাও আছে। বয়স ৬৪। এক সময় হিসাবরক্ষকের চাকরি করতো। থাকতো নেভাদায়। ২৭ বছর আগে ডিভোর্স হয়েছে, খুব অল্প সময় তার বিয়ে টিকেছিল। বধূ নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়নি। সন্তান নেই। গার্লফ্রেন্ড আছে। ফিলিপিনো গার্লফ্রেন্ড, বয়স ৬২, এক সময় ক্যাসিনোতে কাজ করতো। লাস ভেগাসের ৮০ মাইল দূরে স্টিফেনের বাড়ি। জুয়া খেলতো অনলাইনে, খেলতো লাস ভেগাসের ক্যাসিনোতে। প্রতিবেশীরা তাকে ভালো মানুষ বলেই জানে। এক প্রতিবেশীকে বলেছিল, তার বাড়িটা যেন দেখে রাখে, বেশ কিছুদিন সে থাকবে না। তার বাবা ব্যাংক ডাকাতি করেছিল, একবার জেল থেকে পালিয়েও ছিল। ১৯৬৯ সালে এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে ছিল তার বাবা। বাবা মারা গেছে। ভাই থাকে ফ্লোরিডায়।
এই
স্টিফেন প্যাডক লাস ভেগাসের কান্ট্রি মিউজিক কনসার্টে পাশের হোটেলের ৩২
তলার জানালা থেকে ২২,০০০ লোকের ওপর অটোমেটিক রাইফেল থেকে গুলিবর্ষণ করেছে।
জেনে বুঝেই করেছে, তার হোটেল রুমে রুমে ছিল ২৩টা বন্দুক। গাড়ির ভিতর
হাজারেরও বেশি ছিল বুলেট। বাড়িতেও ছিল বন্দুক।
লাস ভেগাস গণহত্যা করেছে সাদা আমেরিকান। ১৯৮২ সাল থেকে যত সন্ত্রাস ঘটেছে আমেরিকায়, সাদা আমেরিকানরাই ঘটিয়েছে সবচেয়ে বেশি। শতকরা ৫৪ ভাগ। তালিকায় তারপরেই আছে কালোদের নাম। সাদারা সন্ত্রাস করলে, আমি বুঝি না, কী কারণে ওদের সন্ত্রাসী বলে ডাকা হয় না। এখনো স্টিফেন প্যাডককে কিন্তু ‘বন্দুকধারী’ বলা হচ্ছে। মনস্তত্ত্ববিদকে ডেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে ওর মাথায় কোনও সমস্যা ছিল কি না। মাথায় সমস্যা থাক বা না থাক, জেনে বুঝে করুক বা অজ্ঞানতায় করুক, স্টিফেন সন্ত্রাসী। বাইশ হাজার মানুষের ভিতরে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও একটা মানুষকে কেন আতঙ্কবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না? তাহলে কি সন্ত্রাসী বা আতঙ্কবাদী হতে গেলে মুসলিম হতে হবে?
কী হতো যদি স্টিফেন প্যাডক মুসলিম হতো, যদি আইসিসের লোক হতো, যদি মানুষ মারার সময় ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করতো? যদি এক হাতে কোরআন থাকতো তার, আরেক হাতে অটোমেটিক রাইফেল, পেছনে আইসিসের কালো পতাকা, পতাকায় সাদা অক্ষরে আরবিতে লেখা কোরআনের বাণী? তাহলে নিশ্চয়ই ট্রাম্প টুইট করতেন, ‘আগেই বলেছিলাম আমি! বলেছিলাম না ওরা আমাদের শত্রু! সাধে কি আর নিষিদ্ধ করেছি মুসলিম দেশগুলো থেকে মানুষ আসা!’ পাগড়ি পরা শিখদের মুসলিম ভেবে গুলি করে মারতো কিছু লোক। মসজিদ থেকে বের হয়ে আসা ইমামদেরও হত্যা করা হতো। আমেরিকায় বাস করা বাদামি যে কোনও লোককেই মুসলিম মনে করে ঘৃণার চোখে দেখা হতো, কারো কারো ওপর আক্রমণ হতো। রিপাবলিকান দল আর তার টি পার্টি জনপ্রিয় হয়ে উঠতো প্রচণ্ড। মুসলিম নাগরিকদের অনেককে সন্ত্রাসী ভেবে হেনস্তা করা হতো। আর ট্রাম্পের যুদ্ধ জাহাজ চলে যেত মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস দমনের নামে বোমাবর্ষণ করতে, দু-একটা আইসিস বা আল কায়দার সন্ত্রাসী মরতো, আর হাজারো নিরীহ মরতো! এই চিত্রটি আমরা কল্পনা করতে পারি।
আমেরিকার এই শিথিল বন্দুক আইনের কারণে আরও কত যে সন্ত্রাসী জন্ম নেবে! অনেকে বলে বন্দুক কেনার অধিকার থাকুক মানুষের। কিন্তু কে কিনছে, কেন কিনছে, বয়স কত, মাথায় কোনও সমস্যা আছে কিনা— এসব তথ্য আরো যাচাই করা হোক।
১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়াতে পোর্ট আর্থার ম্যাসাকার ঘটেছিল, এক পাগলের গুলিতে মারা যায় ৩৫ জন নিরীহ মানুষ। ওই ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়ায় বন্দুক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনের ফলে যে কারো বন্দুক পিস্তল কেনার অধিকার সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। এখন অস্ট্রেলিয়ায় গুলি করে মানুষ হত্যার হার অর্ধেক কমে গেছে, আত্মহত্যার হারও কমেছে অর্ধেক। কিন্তু আমেরিকায় তা হয়নি। ১৯৭০ সালের পর থেকে আত্মহত্যা, হত্যা, আর দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গেছে, তা আমেরিকার ইতিহাসে যত যুদ্ধ হয়েছে, সেই সব যুদ্ধে যত আমেরিকান মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি। প্রতিদিন গড়ে ৯২ জন আমেরিকান মারা যায় বন্দুকের গুলিতে, অন্যান্য উন্নত দেশে যত বাচ্চা মারা যায় গুলিতে, তার চেয়ে ১৪ গুণ বেশি মারা যায় আমেরিকায়।
অনেকে বলেছেন ভালো ব্যবস্থা নিলে অবস্থার উন্নতি সম্ভব। ১৯২১ সালের পর থেকে আমেরিকায় সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক কমে গেছে। সিটবেল্ট, এয়ারব্যাগ, প্যাডেড ড্যাশবোর্ড, ভালো বাম্পার, সড়ক বাতি, হাইওয়ের গার্ড্ররেইল, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালালে শাস্তি, গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ইত্যাদি নানা কিছু এনে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা হয়েছে, গাড়ি নিষিদ্ধ করতে হয়নি। সুতরাং বন্দুক নিষিদ্ধ না করেও বন্দুক জনিত হত্যা-আত্মহত্যা কমানো যায়। সেই চেষ্টা করা হচ্ছে না। এত বড় বিপর্যয় ঘটছে, এত রক্তপাত, তারপরও বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনে হাত দেওয়া হচ্ছে না।
স্টিফেনের সব বন্দুকই বৈধভাবে কেনা। বৈধভাবে কিনে অবৈধ কাজে ব্যবহার করেছে সে। ৪৩টি বন্দুক একজনের ব্যবহারের জন্য কেনা হয়েছে। বন্দুকের দোকানে যা যা দেখার কথা, সবই নাকি দেখেছে। স্টিফেনের কোনও অপরাধের ইতিহাস নেই, সুতরাং তার হাতে থাকতেই পারে মারণাস্ত্র। এই হলো যুক্তি। অতীতে যে অপরাধ করেনি, সে কি আজ অপরাধ করতে পারে না? স্টিফেন প্যাডক ভয়াবহ অপরাধ করিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, অপরাধ আগে না করলেও পরে করা যায়। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনের বদল না ঘটলে ভয়াবহ সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়ার নয়। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ বেশি করলে জনপ্রিয়তা হারাতে হবে, ভোটে জেতা হবে না। রাজনীতিকদের ভয় এখানেই।
স্টিফেন কেন এতগুলো মানুষ মারলো? মেরে আত্মঘাতী হলো? এখনো কারণ জানা যায়নি। জানার চেষ্টা চলছে। মনে পড়ছে জন লেননের খুনিকে, প্রতিভা নেই তার, সে বিখ্যাত হতে পারবে না এ জীবনে, কিন্তু নোবডি থেকে সামবডি হতে পারবে যদি লেননকে খুন করে, সেই সামবডি হওয়ার জন্যই খুন করা। স্টিফেনেরও কি সেরকম কোনও কারণ? ধন সম্পদ প্রচুর। জীবনে নাম হলো না। পত্রিকার পাতায় কোনও দিন নাম ছাপা হলো না। কী করলে বিশ্বজুড়ে সবাই উচ্চারণ করবে স্টিফেন প্যাডকের নাম? ভালো লোক হিসেবে লোকের যদি তাকে চেনার কোনও সম্ভাবনা নেই, অন্তত মন্দ লোক হিসেবেই লোকে তাকে চিনুক। এত অচেনা হয়ে, এত নোবডি হয়ে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবে! এ মেনে নেওয়া যায় না। মরতে যখন হবেই, তখন না হয় মেরেই মরি মানুষকে। অগুনতি মানুষের মৃত্যুর কারণেও যদি মানুষ তাকে মনে রাখে, মনে রাখুক। এও হতে পারে, আবার আরেকটি কারণও হতে পারে, আমি তো গান শুনে আনন্দ পাই না, অত লোক আনন্দ কী করে পায়, কেন পায়, ওদের আমার সহ্য হচ্ছে না, ওদের অত সুখ দেখতে আমার ভালো লাগছে না। জানি না আসল কী কারণ। শিগগিরই বের হবে কারণ।
স্টিফেনের মাথায় যদি সমস্যা থাকে, সমস্যার কারণে গণহত্যায় অংশ নিয়ে থাকে, তাহলে ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস করে, তাদের মাথাতেও সমস্যা আছে! সমস্যা না থাকলে কি মানুষ হয়ে মানুষকে খুন করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব, হয়তো মানুষ এমনই, নৃশংস। কিন্তু আমরা আমাদের নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা নিয়ন্ত্রণ করে রাখি মাত্র।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
বোমা মারা হলো কোনও বাসে বা বিল্ডিংয়ে, কোনও মার্কেটে বা মসজিদে। আমরা ধরে নিই, এটি ইসলামিক কোনও দলের কর্ম। লাস ভেগাসের কনসার্টে গুলির বৃষ্টি ঝরিয়ে যে স্টিফেন প্যাডক নামের এক লোক ৫৯ জন নিরীহ মানুষকে খুন করেছে, ৫২৭ নিরীহ মানুষকে আহত করেছে... সে লোক কিন্তু মুসলিম নয়। তার গায়ের রঙ কালো বা বাদামি নয়। তার গায়ের রঙ সাদা। ধর্ম, রাজনীতি, হিংসে, বিদ্বেষ— এসবের মধ্যেই নেই সে। তারপরও স্টিফেন খুন করেছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। স্টিফেন প্যাডক কোটিপতি। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা আছে তার। জুয়োর নেশাও আছে। বয়স ৬৪। এক সময় হিসাবরক্ষকের চাকরি করতো। থাকতো নেভাদায়। ২৭ বছর আগে ডিভোর্স হয়েছে, খুব অল্প সময় তার বিয়ে টিকেছিল। বধূ নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়নি। সন্তান নেই। গার্লফ্রেন্ড আছে। ফিলিপিনো গার্লফ্রেন্ড, বয়স ৬২, এক সময় ক্যাসিনোতে কাজ করতো। লাস ভেগাসের ৮০ মাইল দূরে স্টিফেনের বাড়ি। জুয়া খেলতো অনলাইনে, খেলতো লাস ভেগাসের ক্যাসিনোতে। প্রতিবেশীরা তাকে ভালো মানুষ বলেই জানে। এক প্রতিবেশীকে বলেছিল, তার বাড়িটা যেন দেখে রাখে, বেশ কিছুদিন সে থাকবে না। তার বাবা ব্যাংক ডাকাতি করেছিল, একবার জেল থেকে পালিয়েও ছিল। ১৯৬৯ সালে এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে ছিল তার বাবা। বাবা মারা গেছে। ভাই থাকে ফ্লোরিডায়।
লাস ভেগাস গণহত্যা করেছে সাদা আমেরিকান। ১৯৮২ সাল থেকে যত সন্ত্রাস ঘটেছে আমেরিকায়, সাদা আমেরিকানরাই ঘটিয়েছে সবচেয়ে বেশি। শতকরা ৫৪ ভাগ। তালিকায় তারপরেই আছে কালোদের নাম। সাদারা সন্ত্রাস করলে, আমি বুঝি না, কী কারণে ওদের সন্ত্রাসী বলে ডাকা হয় না। এখনো স্টিফেন প্যাডককে কিন্তু ‘বন্দুকধারী’ বলা হচ্ছে। মনস্তত্ত্ববিদকে ডেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে ওর মাথায় কোনও সমস্যা ছিল কি না। মাথায় সমস্যা থাক বা না থাক, জেনে বুঝে করুক বা অজ্ঞানতায় করুক, স্টিফেন সন্ত্রাসী। বাইশ হাজার মানুষের ভিতরে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও একটা মানুষকে কেন আতঙ্কবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না? তাহলে কি সন্ত্রাসী বা আতঙ্কবাদী হতে গেলে মুসলিম হতে হবে?
কী হতো যদি স্টিফেন প্যাডক মুসলিম হতো, যদি আইসিসের লোক হতো, যদি মানুষ মারার সময় ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করতো? যদি এক হাতে কোরআন থাকতো তার, আরেক হাতে অটোমেটিক রাইফেল, পেছনে আইসিসের কালো পতাকা, পতাকায় সাদা অক্ষরে আরবিতে লেখা কোরআনের বাণী? তাহলে নিশ্চয়ই ট্রাম্প টুইট করতেন, ‘আগেই বলেছিলাম আমি! বলেছিলাম না ওরা আমাদের শত্রু! সাধে কি আর নিষিদ্ধ করেছি মুসলিম দেশগুলো থেকে মানুষ আসা!’ পাগড়ি পরা শিখদের মুসলিম ভেবে গুলি করে মারতো কিছু লোক। মসজিদ থেকে বের হয়ে আসা ইমামদেরও হত্যা করা হতো। আমেরিকায় বাস করা বাদামি যে কোনও লোককেই মুসলিম মনে করে ঘৃণার চোখে দেখা হতো, কারো কারো ওপর আক্রমণ হতো। রিপাবলিকান দল আর তার টি পার্টি জনপ্রিয় হয়ে উঠতো প্রচণ্ড। মুসলিম নাগরিকদের অনেককে সন্ত্রাসী ভেবে হেনস্তা করা হতো। আর ট্রাম্পের যুদ্ধ জাহাজ চলে যেত মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস দমনের নামে বোমাবর্ষণ করতে, দু-একটা আইসিস বা আল কায়দার সন্ত্রাসী মরতো, আর হাজারো নিরীহ মরতো! এই চিত্রটি আমরা কল্পনা করতে পারি।
আমেরিকার এই শিথিল বন্দুক আইনের কারণে আরও কত যে সন্ত্রাসী জন্ম নেবে! অনেকে বলে বন্দুক কেনার অধিকার থাকুক মানুষের। কিন্তু কে কিনছে, কেন কিনছে, বয়স কত, মাথায় কোনও সমস্যা আছে কিনা— এসব তথ্য আরো যাচাই করা হোক।
১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়াতে পোর্ট আর্থার ম্যাসাকার ঘটেছিল, এক পাগলের গুলিতে মারা যায় ৩৫ জন নিরীহ মানুষ। ওই ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়ায় বন্দুক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনের ফলে যে কারো বন্দুক পিস্তল কেনার অধিকার সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। এখন অস্ট্রেলিয়ায় গুলি করে মানুষ হত্যার হার অর্ধেক কমে গেছে, আত্মহত্যার হারও কমেছে অর্ধেক। কিন্তু আমেরিকায় তা হয়নি। ১৯৭০ সালের পর থেকে আত্মহত্যা, হত্যা, আর দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গেছে, তা আমেরিকার ইতিহাসে যত যুদ্ধ হয়েছে, সেই সব যুদ্ধে যত আমেরিকান মারা গেছে, তার চেয়ে বেশি। প্রতিদিন গড়ে ৯২ জন আমেরিকান মারা যায় বন্দুকের গুলিতে, অন্যান্য উন্নত দেশে যত বাচ্চা মারা যায় গুলিতে, তার চেয়ে ১৪ গুণ বেশি মারা যায় আমেরিকায়।
অনেকে বলেছেন ভালো ব্যবস্থা নিলে অবস্থার উন্নতি সম্ভব। ১৯২১ সালের পর থেকে আমেরিকায় সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক কমে গেছে। সিটবেল্ট, এয়ারব্যাগ, প্যাডেড ড্যাশবোর্ড, ভালো বাম্পার, সড়ক বাতি, হাইওয়ের গার্ড্ররেইল, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালালে শাস্তি, গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ইত্যাদি নানা কিছু এনে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা হয়েছে, গাড়ি নিষিদ্ধ করতে হয়নি। সুতরাং বন্দুক নিষিদ্ধ না করেও বন্দুক জনিত হত্যা-আত্মহত্যা কমানো যায়। সেই চেষ্টা করা হচ্ছে না। এত বড় বিপর্যয় ঘটছে, এত রক্তপাত, তারপরও বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনে হাত দেওয়া হচ্ছে না।
স্টিফেনের সব বন্দুকই বৈধভাবে কেনা। বৈধভাবে কিনে অবৈধ কাজে ব্যবহার করেছে সে। ৪৩টি বন্দুক একজনের ব্যবহারের জন্য কেনা হয়েছে। বন্দুকের দোকানে যা যা দেখার কথা, সবই নাকি দেখেছে। স্টিফেনের কোনও অপরাধের ইতিহাস নেই, সুতরাং তার হাতে থাকতেই পারে মারণাস্ত্র। এই হলো যুক্তি। অতীতে যে অপরাধ করেনি, সে কি আজ অপরাধ করতে পারে না? স্টিফেন প্যাডক ভয়াবহ অপরাধ করিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, অপরাধ আগে না করলেও পরে করা যায়। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনের বদল না ঘটলে ভয়াবহ সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়ার নয়। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ বেশি করলে জনপ্রিয়তা হারাতে হবে, ভোটে জেতা হবে না। রাজনীতিকদের ভয় এখানেই।
স্টিফেন কেন এতগুলো মানুষ মারলো? মেরে আত্মঘাতী হলো? এখনো কারণ জানা যায়নি। জানার চেষ্টা চলছে। মনে পড়ছে জন লেননের খুনিকে, প্রতিভা নেই তার, সে বিখ্যাত হতে পারবে না এ জীবনে, কিন্তু নোবডি থেকে সামবডি হতে পারবে যদি লেননকে খুন করে, সেই সামবডি হওয়ার জন্যই খুন করা। স্টিফেনেরও কি সেরকম কোনও কারণ? ধন সম্পদ প্রচুর। জীবনে নাম হলো না। পত্রিকার পাতায় কোনও দিন নাম ছাপা হলো না। কী করলে বিশ্বজুড়ে সবাই উচ্চারণ করবে স্টিফেন প্যাডকের নাম? ভালো লোক হিসেবে লোকের যদি তাকে চেনার কোনও সম্ভাবনা নেই, অন্তত মন্দ লোক হিসেবেই লোকে তাকে চিনুক। এত অচেনা হয়ে, এত নোবডি হয়ে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবে! এ মেনে নেওয়া যায় না। মরতে যখন হবেই, তখন না হয় মেরেই মরি মানুষকে। অগুনতি মানুষের মৃত্যুর কারণেও যদি মানুষ তাকে মনে রাখে, মনে রাখুক। এও হতে পারে, আবার আরেকটি কারণও হতে পারে, আমি তো গান শুনে আনন্দ পাই না, অত লোক আনন্দ কী করে পায়, কেন পায়, ওদের আমার সহ্য হচ্ছে না, ওদের অত সুখ দেখতে আমার ভালো লাগছে না। জানি না আসল কী কারণ। শিগগিরই বের হবে কারণ।
স্টিফেনের মাথায় যদি সমস্যা থাকে, সমস্যার কারণে গণহত্যায় অংশ নিয়ে থাকে, তাহলে ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস করে, তাদের মাথাতেও সমস্যা আছে! সমস্যা না থাকলে কি মানুষ হয়ে মানুষকে খুন করা সম্ভব? হয়তো সম্ভব, হয়তো মানুষ এমনই, নৃশংস। কিন্তু আমরা আমাদের নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা নিয়ন্ত্রণ করে রাখি মাত্র।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
Post Comment
No comments