রাজনীতির নানা কথা ও নির্বাচন কমিশন
আবু জাফর
২০ আগস্ট ২০১৭,রবিবার, ০০:০০
১
একদা মূষিক বর্তমানে বিশালবপু ঐরাবত, এ রকম ঐরাবতরূপী ধনাঢ্য মানুষের সংখ্যা অনেক নয়, অসংখ্য। রাজনীতির তৃণমূল থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত এ ধরনের ভাগ্যবান ঐরাবত সর্বত্রই পরিদৃশ্যমান। অবশ্য এটা সত্য, চোখে পড়ার
মতো কিছু ব্যতিক্রমও আছে। কিন্তু দুঃখ হলো, সক্রিয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও যারা আর্থিকভাবে সৎ ও দরিদ্র, ক্ষমতার ভেতরে-বাইরে যেখানেই অবস্থান করুন, তাদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য। অবশ্য এ সাথে উল্লেখ করি, এই নির্লোভ নগণ্য পুরুষেরাই আমাদের গৌরব ও অহঙ্কার, যারা ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন মূর্খের’ মতো অর্থলোভকে পরাভূত করতে সক্ষম, যারা নিজেকে ও রাজনীতিকে কুৎসিত ভ্রান্তিবিলাস থেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।
যা-ই হোক, যে বিষয়টি শুরুতেই উল্লেখ করব বলে ভাবছি তাহলো, দেশের রাজনীতি যদি ক্ষমতালোভ ও অর্থলিপ্সার করুণ শিকারে পরিণত হয়, তাহলে দেশ ও দেশের রাজনীতি নানা অনুচিত উপচ্ছায়া ও উপসর্গ দিয়ে আক্রান্ত হবে সেটাই স্বাভাবিক, শুধু স্বাভাবিক নয়, রীতিমতো অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী। বস্তুত তাই-ই হয়েছে। যে কারণে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে উচ্চকণ্ঠ ফাঁকা আওয়াজ যতটা শোনা যায়, তার এক শতাংশও স্বচ্ছতা ও আত্মনিষ্ঠার পরিচয় মেলে না। রাজনীতি হয়ে ওঠে অসূয়া বিদ্বেষ গ্লানি ও পরস্পরের প্রতি সীমাহীন দুশমনির আধার, অনেকটা যেন গ্রিক-গ্লাডিয়েটরদের সদম্ভ পদভারে কম্পমান মল্লভূমি। শুধু তাই নয়, এমনকি রাজনীতির ভাষাও হয়ে ওঠে শিষ্টাচারবর্জিত অভব্য ও আক্রমণাত্মক। এ এক মহা সঙ্কট, যাকে রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য সহচর হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অপর একটি উৎকট সমস্যা হলো আত্মপ্রশংসা। চাটুকারিতা কি স্তাবকতা কথঞ্চিৎ সহনীয়, কিন্তু আত্মপ্রশংসা একেবারেই একটি অসহ্য উপাদান; কারণ শুধু ক্লিব ও আত্মমর্যাদাহীন মানুষের পক্ষেই আত্মপ্রশংসাকে প্রীতিকর জ্ঞান করা সম্ভব। অথচ দেশের বেশির ভাগ রাজনীতিকই এই অশ্রাব্য আকর্ষণে উৎসাহী ও আত্মভ্রষ্ট। মনে রাখা প্রয়োজন, আসলে এতে আদৌ কিছু হয় না, এতে শুধু নিজের কাছে ও অপরের কাছে অকারণে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তোলা হয়; এবং এতে মানুষের কাছে নিজের আত্মসম্মান নষ্ট করা হয় মাত্র। রাজনীতিকদের এটুকু অন্তত বোঝা উচিত, আত্মপ্রশংসা যেহেতু আত্মক্ষয়ের কারণ হয়ে ওঠে, একে পরিহার করাই সর্বতোভাবে বাঞ্ছনীয়। শেখ সাদী রহ: বলেছেনÑ আত্মপ্রশংসা হলো নিজেই নিজেকে আদর করা। এই নিজের কাছে নিজে আদর খাওয়ার ছেলেমি প্রবণতা যদি সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে, তাহলে রাজনীতির ময়দান আর ঘন বিশ্বাসের আবরণে স্নিগ্ধ ও গম্ভীর না থেকে হয়ে ওঠে জনগণের হাসি ও তামাশাস্থল, হয়ে ওঠে একপ্রকার কটু রসে পিচ্ছিল এবং তরল ও আত্মবিলাসী। তাই যারা নিজেকে দেশ এবং জনগণের বিশ্বাস ও নির্ভরতার অকৃত্রিম আশ্রয় বলে মনে করেন, তারা কখনোই তরল এবং পিচ্ছিল ও তামাশালালিত কুহক দিয়ে চালিত হতে পারেন না এবং কোনো ধরনের স্বেচ্ছাকৃত ও স্বসৃষ্ট অপঘাতে আত্মবিসর্জনও দিতে পারেন না। আসলে কথার সংযমে ও মহিমায় যারা হয়ে উঠতে পারেন প্রিয় ও আস্থাশীল এবং মানুষের কাছে প্রণম্য, তুচ্ছ কারণে অর্থাৎ আত্মপ্রশংসার দাসত্ব করতে গিয়ে তারাই হয়ে ওঠেন অনেকটা রসনাবিলাসী বিদূষক। তারা নিজে কোনো ক্ষতি অনুভব করেন কি না জানি না, তবে তাদের এই লোকমজানো উচ্ছ্বাস দেশ ও রাজনীতির জন্য সর্বার্থে অসমীচীন। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, আত্মপ্রশংসার দুর্বার স্রোতে তারা হয়ে ওঠেন প্রতিপক্ষের প্রতি শরনিক্ষেপে এক একজন নিপুণ কিন্তু অসংযমী তীরন্দাজ। অনুমান করি এ থেকে নিজের খুব একটা লাভ হয় না, বরং শরবিদ্ধ প্রতিপক্ষই লাভবান হয়। এটাই নিয়ম, এ রকমই হয়, আঘাত চিরদিনই ফিরে আসে যেখান থেকে তার জন্ম সেখানে। এ জন্যই হজরত আলী রা: বলেছিলেনÑ ‘ওই ব্যক্তি বড় দুর্ভাগা যে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত বিলম্বে করে’।
যা-ই হোক, আর বেশি কথা নয়। এখন অত্যাসন্ন জাতীয় নির্বাচন পূর্ববর্তী যে বিশেষ কথাগুলো ব্যক্ত করা জরুরি সেই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই একটি সমস্যাসঙ্কুল দেশ এবং সমস্যাগুলো এমন, যা ইচ্ছা করলেই পরাভূত করা সম্ভব নয়। ঝড়-জল-বন্যা, ভূমির সীমাবদ্ধতা, সর্বোপরি অস্বাভাবিক জনসংখ্যাÑ সবগুলোই প্রকৃতিগতভাবে এক-একটি স্থায়ী নির্মমতা, যা কোনো চেষ্টা, মেধা ও সংগ্রামের মাধ্যমে দূরীভূত করা অসম্ভব, এমনকি প্রশমিত করাও অসম্ভব। অর্থাৎ এক দুর্নিবার নিয়তি দিয়ে ঘোরতরভাবে আমরা অন্তরীণ। এটা ঠিক, আমাদের কোনো প্রাণঘাতী বহিঃশত্রু নেই। আমাদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে এমন কোনো আগ্রাসী শক্তিও আপাতত দৃশ্যমান নয়। কিন্তু এটাও তো সমধিক সত্য, আমরা নিজেই যদি নিজের শত্রু হয়ে উঠি, সেই সঙ্কট ক্রমাগত ঘনীভূত হয়ে আমাদের অস্তিত্বকে একসময় বিপন্ন করে তুলবেই। এ থেকে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। শুধু ক্ষমতায় থাকা না থাকার প্রশ্ন নয়, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের প্রশ্নও নয়, এই প্রশ্ন টিকে থাকার প্রশ্ন। আর এই টিকে থাকা মানে ক্ষমতায় টিকে থাকা নয়, টিকে থাকার অর্থ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে দেশ ও জনগণকে টিকিয়ে রাখা। বলা দরকার বহিঃশত্রুর আগ্রাসন প্রতিহত করা কঠিন; কিন্তু অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা হেফাজত করা আরো বেশি কঠিন। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরভাগ যদি বিচলিত ও চঞ্চল হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে কারণে-অকারণে শিথিল ও উৎকেন্দ্রিক, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই লঘু বিষয়াদিকে লঘুভাবে বিবেচনা করে রাজনীতিবিদদের সঠিক কর্ম হলো, দেশকে ভ্রাতৃঘাতী তৎপরতা থেকে রক্ষা করা, উৎকেন্দ্রিকতাকে স্তিমিত করে তোলা এবং যেকোনো ধরনের ঈর্ষা ও অসূয়াকে স্তব্ধ করে রাখা।
ইলেকশন আসবে, ধারণা হয় সে ইলেকশনে সব দল অংশ নেবে। এ নিয়ে বেশি শিরপীড়া ও বেশি পেরেশানি বোধ হয় কিছুটা মানসিক বৈকল্যেরই পরিচয় বহন করে। তবে ইলেকশন নিয়ে যে একটা ঘোরতর বিতর্ক দানা বেঁধে উঠছে এটা সুস্পষ্ট। ক্ষমতাসীন দল বলছে, ক্ষমতায় সমাসীন থেকেই নির্বাচন করা হবে এবং তা হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই অধীনে। অন্য দিকে বিএনপি বলছে, নির্বাচন হতে হবে কোনো না কোনোরূপ সহায়ক সরকারের অধীনে, কোনো অবস্থাতেই ‘ব্লু প্রিন্ট’ নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। আর এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন চিন্তামগ্ন হয়ে ভাবছে, এমন দুরূহ অবস্থার মধ্যে কী করে অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যাবে! রোডম্যাপের কিছু সুপারিশ ঘোষণা করার পরেও কমিশন চিন্তামুক্ত হতে পারছে না। ভাবনার কথাই বটে! অবশ্যই আমরা আমাদের মতো ভাবছি। আমরা চাই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক এবং ইনসাফপূর্ণ হোক। এমন ইনসাফ, যা পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবাইকে শান্তি ও স্বস্তি এবং কলহমুক্ত অবস্থার নিশ্চয়তা দিতে পারে। এমন ইনসাফ, যাকে বলা হয়েছে Justice is no justice unless it is divine’। বস্তুতপক্ষে আমাদের সবারই মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি, দেশটা কোনো আলেকজান্ডার বা জুলিয়াস সিজরের দেশ নয়, দেশটা এ দেশের জনগণের দেশ। আর এই জনগণ পর্যাপ্ত বুদ্ধিসম্পন্ন হয়তো নয়, কিন্তু খুব সহজাতভাবেই এটা বুঝতে পারে, কে অকৃত্রিম বন্ধু আর কে আততায়ী, বুঝতে পারে কোনটা চালাকি ও শঠতা, আর কোনটা প্রেম ও মনুষ্যত্বনিষ্ঠা।
২
পূর্ববর্তী আলোচনায় স্থানাভাববশত সব কথা তুলে ধরা যায়নি; ইনসাফের কথা দিয়ে শেষ করেছিলাম। বর্তমান আলোচনাটি আগের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা বিশদভাবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করব। আগেই বলেছি, সীমাহীন ক্ষমতালিপ্সা ও অর্থলোভ, আত্মপ্রশংসা, প্রতিপক্ষের প্রতি অপ্রতিহত ও অভব্য ঈর্ষাকাতরতা, ভারসাম্যহীনতাÑ এই সব কিছু মিলিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ময়দান এমন এক যৌগিক অসমতল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে শুভত্ব ও সুষমা প্রায় অন্তর্হিত এবং এ জন্যই কেউ কেউ সরস ও বিদ্রƒপাত্মক ভঙ্গিতে বলে, বাংলাদেশ বস্তুতপক্ষেই একটি স্বর্ণডিম্বপ্রসবিনী রাজহংস এবং এই হংসের মহিমাগুণেই বহু মানুষ আজ আরব্য-উপন্যাসের অবাক আলাদিন। আমরা মনে মনে শুধু হাসি। কেউ কেউ এমন কথাও বলেন, বাংলাদেশ এক হতভাগিনী কামধেনু, যার বাঁট থেকে দুধ নিঃশেষ হয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে; কিন্তু নির্মম দোহনক্রিয়া কিছুতেই থামছে না। এই কথার পরও আমরা শুধু মনে মনে হাসি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, আমাদের অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত একজন সরলপ্রাণ বয়স্ক ও বিদগ্ধ মানুষ। তিনি অনেক কিছু বোঝেন ও জানেন; সম্ভবত শুধু এইটুকু জানেন না যে, অর্থ-শিকারি মতলবি মানুষেরা মুখে যাই-ই বলুক, তাদের একমাত্র আরাধ্য হলো অর্থ এবং শুধুই অর্থ।
বলাবাহুল্য, ইনসাফ হলো মানবজীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ ও উপজীব্য; তা লঙ্ঘিত কী বিঘিœত হলে জীবনের অর্থ ও সুষমা ফিকে হয়ে আসে ও মিলিয়ে যায়। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গন যদি ইনসাফভ্রষ্ট ও বিবেকবিচ্ছিন্ন পদচারণায় পিষ্ট হতে থাকে, তাহলে সেই ক্ষতি অন্য কোনো সৎকর্ম দ্বারা আদৌ প্রশমিত করা যায় না। আর এই জন্যই যেখানে ইনসাফ আছে সেখানে সবই আছে। যেখানে ইনসাফ নেই সেখানে কিছুই নেই। এটা শতকরা একশত ভাগ সত্য যে, এই ইনসাফ কোনো আত্মপ্রসাদকামী মানুষের লোক দেখানো বস্তু নয়। ইনসাফকে হতে হয় উরারহব এবং এ জন্য ন্যূনতম ইনসাফভ্রষ্টতাও সর্বতোভাবে পরিহার্য। কারণ An injustice anywhere is a threat to justice everywhere’। অর্থাৎ ইনসাফ রক্ষা করার ক্ষেত্রে কণামাত্র অন্যথা হলেও সেটা গুরুতরভাবে আত্মবিনাশকে ত্বরাম্বিত ও অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এ দিক থেকে আমাদের রাজনীতি কি সঠিক ও ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে? দিচ্ছে না। অতএব, যতভাবেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা হোক, রাজনীতির বিস্তীর্ণ পরিসরে ইসনাফের স্থান খুবই সঙ্কীর্ণ। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশ অনিরুদ্ধ সমূহ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য অনুমান করি, আমাদের এই কথায় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কিছু কিছু ব্যক্তি রুষ্ট ও উষ্মাগ্রস্ত হতে পারেন। কিন্তু আমাদের এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই। কারণ সত্য কথা বলার প্রশ্নে নীরবতা অবশ্যই অপরাধ ও অনভিপ্রেত।
আল কুরআনে এই ইনসাফকে বলা হয়েছে মিজান বা ভারসাম্য। জগতে-মহাজগতে এই ভারসাম্য নিখুঁতভাবে বর্তমান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মানুষ তার অসাধু প্রবণতার চাপে ইনসাফকে পদপিষ্ট করার এক দুর্বার আগ্রহ ও উৎসাহ দ্বারা চালিত, যার ফলাফল তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হয়। আমরা ব্যক্ত করতে পারি, পৃথিবীতে যত সমস্যা ও সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা সবই এই ইনসাফ-বিবর্জিত ব্যবস্থাপনার কারণে। অতএব আসন্ন নির্বাচনকে সর্বসম্মত সুষ্ঠুতা দানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে উচিত হবে, অব্যবস্থা ও অসমতল ক্ষেত্রবিন্যাস থেকে যথাসম্ভব দূরে অবস্থান করা এবং নিখুঁতভাবে ‘মিজান’ রক্ষা করা। পরিমিতিবোধ বা ভারসাম্য সঠিকভাবে রক্ষিত না হলে কী হয়, তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো টাইটানিক। এই জাহাজ বরফের গায়ে প্রতিহত হয়ে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় জলমগ্ন হলো এবং ডুবে যাওয়ার জন্য যে সময় লাগার কথা ছিল, তার চেয়ে অনেক কম সময়ে নিমজ্জিত হয়ে যায়। পুরো বিষয়টি গবেষণান্তে জানা গেল, টাইটানিকের বডি নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণাদির যে আনুপাতিক পরিমাণ সঠিক নিয়মে রক্ষা করার কথা, তা রক্ষা করা হয়নি। অর্থাৎ দ্বিখণ্ডিত হয়ে নিমজ্জিত হওয়ার কারণ টাইটানিকের নির্মাণকর্মে পরিমিতির অভাব বা ভারসাম্যহীনতা।
আলোচনা সূত্রে অপর একটি বিষয় উল্লেখ করা অতীব জরুরি। তা হলো বিভেদ ও বৈষম্য। এই বিভেদ ও বৈষম্যহেতু সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে। কারণ বৈষম্য একটি ব্যাধি, যা সব ইতিবাচক দিককে পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত করে দেয় এবং পরিশেষে এমন অবস্থা প্রকট হয়ে ওঠে যে, দেশকে আর একতাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় না। স্মরণ করি, পাকিস্তান যে ভেঙে পড়ল, তার প্রধান কারণ এই বৈষম্য, যা পাকিস্তানকে এমনভাবে রাহুগ্রস্ত করে তুলেছিল যে, ভেঙে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিল না। রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যারা সক্রিয় তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারেন, বৈষম্য শুধু একটি রোগ নয়; এই রোগের প্রভাবে খুব স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয় ক্লেদ ও গ্লানি, হিংসা, কুহক ও অন্ধকার, যা কোনো দেশকে ভেতরে ভেতরে একেবারে ফাঁপা ও রক্তশূন্য করে তোলে।
এখনো সময় আছে; তবু মনে হচ্ছে, নির্বাচন অনেকটা দ্রুতগতিতেই এগিয়ে আসছে। সব দলের মধ্যেই নির্বাচনমুখী তৎপরতা ভালোভাবেই শুরু হয়ে গেছে। যে দল যেভাবে পারছে, তাদের প্রচার ও কর্মকৌশল নিয়ে এখন জনগণের সম্মুখীন। কী হবে না হবে, ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সে কথা আল্লাহ পাক জানেন। আমরা শুধু এইটুকু জানি, কোনো গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তার ভবিষ্যদ্বাণী একেবারেই অর্থহীন। ‘ধন্বন্তরী’ কোনো পাথর পরিধান করাও সমান অর্থহীন। বরং যারা বস্তুনিষ্ঠ গবেষক, যারা দেশ ও জনগণের চিন্তা ও বিশ্বাসের গতিবিধি সম্পর্কে কথঞ্চিৎ ওয়াকিবহাল, তারা হয়তো অগ্রিম কিছু বললেও বলতে পারেন। তবে তাদের ভাবনাকেও অধিক মূল্য দেয়া খুব সমীচীন হবে না; বরং অপেক্ষা করাই শ্রেয়। বস্তুত দেশ শাসনের গুরুভার ও দায়িত্ব কার ওপর অর্পিত হবে, সেটা প্রকৃতপক্ষেই এক রহস্য। কৌতূহল দমন করা কিছুটা কষ্টসাধ্য বটে; কিন্তু রহস্যের আবরণ ছিন্ন করার চেষ্টা আসলেই যেহেতু নিরর্থক ক্লেশ ও শ্রমক্ষয়, এ থেকে দূরে থাকাই উত্তম। বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষ কী চায়, কী তাদের স্বপ্ন ও বিশ্বাস ও প্রত্যাশা, সেই দিকে দৃষ্টিপাত করাই সর্বার্থে কল্যাণকর। জনগণ বেশি কিছু আশা করে না, শুধু এইটুকু চায় যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক এবং এমন সব মানুষ বিজয় মুকুটে শোভিত হোক, যারা সৎ ও নির্ভীক, যারা জনগণের ইচ্ছা ও বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে যথাসময়ে যথোচিত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম। চালাকি দ্বারা সাময়িক জয় লাভ করা যায়, কিন্তু চালাকি যে মুনাফেকির নামান্তর, এটা একসময় প্রমাণ হবেই। অতএব, মানুষ চায় এমন মানুষের বিজয়, কোনো বহিঃশক্তির রক্তচক্ষু বা চতুর স্তাবকতা অথবা অভ্যন্তরীণ হুমকি ও ত্রাস যাকে কণামাত্র বিহ্বল কী বিচলিত করার স্পর্ধা না রাখে, যার কর্তব্যবোধ ও দেশপ্রেম বাক্সময় হয়ে উঠবে বীরত্ব, সাহস, সততা ও দূরদর্শিতা দিয়ে। কবি ইকবাল যথার্থই বলেছেন: ‘সবক্ ফের পড়্ সাদাকাত্ কা আদালত্ কা শুজাবাত্ কা; লে যায়েগা তুঝ্ সে কাম দুনিয়া কা ইমামত কা’Ñ সততা ইনসাফ এবং বীরত্বের পাঠ গ্রহণ করা হলে শুধু দেশ নয়, সমগ্র পৃথিবীই তার নেতৃত্ব বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে এগিয়ে আসবে।
মনে রাখা আবশ্যক, রাজ্য শাসনের ক্ষমতা লাভ করা মহান আল্লাহ পাকের তরফ থেকে প্রদত্ত একটি আমানত। এই আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য। আর যদি তা না হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি বা দল প্রকৃতপক্ষেই নাফরমান-খেয়ানতকারী হিসেবে গণ্য হবে। অতএব, জনগণ চায় এমন একটি নির্বাচন যাকে জনগণ স্বাগত জানাতে পারে, সেটা সংবিধানসম্মতই হোক অথবা অন্য যাই-ই হোক, কোনো কিছুর বিনিময়েই জনগণকে কোনো চালাকির ফাঁদে অবরুদ্ধ রাখা নিঃসন্দেহে খুবই গর্হিত কর্ম। অবশ্য এই সহজ সত্য কথাটি অনেকেই ভুলে থাকতে ভালোবাসেন। এই জন্যই এমন সব মানুষ এগিয়ে আসেন বা এগিয়ে আসার সুযোগ পান, যারা নৈতিক মানদণ্ডে একেবারেই ভীরু ও স্বার্থান্ধ; একেবারেই অসার ও অথর্ব, যারা নিজের কাছেও তরল ও ন্যুব্জ ও আত্মবিভক্ত; অপরের কাছে তো বটেই। বলাবাহুল্য, আসন্ন ভোটযুদ্ধের প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনই আমাদের সর্বশেষ ভরসাস্থল। চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাই আকাশে নানা বর্ণের মেঘের বিক্ষিপ্ত আনাগোনা। বহু অনুচিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা হয়তো ঘটবে, তারপরও আশা রাখতে চাই, সর্বতোমুখী ন্যায্যতা ও ইনসাফ নিশ্চয়ই অক্ষুণœ থাকবে; জাতি নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় একেবারে আশাহত হবে না। দুঃখ ও শঙ্কা-আশঙ্কার কথা একটাই তা হলোÑ পর্যাপ্ত সতর্কতার মধ্যেও ইবলিসের আগমন ঘটে এবং চতুর ও মতলবি তীরন্দাজদের নিশানা কখনোই একেবারে লক্ষচ্যুত হয় না।
লেখক : গীতিকার, সাহিত্যিক
একদা মূষিক বর্তমানে বিশালবপু ঐরাবত, এ রকম ঐরাবতরূপী ধনাঢ্য মানুষের সংখ্যা অনেক নয়, অসংখ্য। রাজনীতির তৃণমূল থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত এ ধরনের ভাগ্যবান ঐরাবত সর্বত্রই পরিদৃশ্যমান। অবশ্য এটা সত্য, চোখে পড়ার
মতো কিছু ব্যতিক্রমও আছে। কিন্তু দুঃখ হলো, সক্রিয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও যারা আর্থিকভাবে সৎ ও দরিদ্র, ক্ষমতার ভেতরে-বাইরে যেখানেই অবস্থান করুন, তাদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য। অবশ্য এ সাথে উল্লেখ করি, এই নির্লোভ নগণ্য পুরুষেরাই আমাদের গৌরব ও অহঙ্কার, যারা ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন মূর্খের’ মতো অর্থলোভকে পরাভূত করতে সক্ষম, যারা নিজেকে ও রাজনীতিকে কুৎসিত ভ্রান্তিবিলাস থেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।
যা-ই হোক, যে বিষয়টি শুরুতেই উল্লেখ করব বলে ভাবছি তাহলো, দেশের রাজনীতি যদি ক্ষমতালোভ ও অর্থলিপ্সার করুণ শিকারে পরিণত হয়, তাহলে দেশ ও দেশের রাজনীতি নানা অনুচিত উপচ্ছায়া ও উপসর্গ দিয়ে আক্রান্ত হবে সেটাই স্বাভাবিক, শুধু স্বাভাবিক নয়, রীতিমতো অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী। বস্তুত তাই-ই হয়েছে। যে কারণে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে উচ্চকণ্ঠ ফাঁকা আওয়াজ যতটা শোনা যায়, তার এক শতাংশও স্বচ্ছতা ও আত্মনিষ্ঠার পরিচয় মেলে না। রাজনীতি হয়ে ওঠে অসূয়া বিদ্বেষ গ্লানি ও পরস্পরের প্রতি সীমাহীন দুশমনির আধার, অনেকটা যেন গ্রিক-গ্লাডিয়েটরদের সদম্ভ পদভারে কম্পমান মল্লভূমি। শুধু তাই নয়, এমনকি রাজনীতির ভাষাও হয়ে ওঠে শিষ্টাচারবর্জিত অভব্য ও আক্রমণাত্মক। এ এক মহা সঙ্কট, যাকে রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য সহচর হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অপর একটি উৎকট সমস্যা হলো আত্মপ্রশংসা। চাটুকারিতা কি স্তাবকতা কথঞ্চিৎ সহনীয়, কিন্তু আত্মপ্রশংসা একেবারেই একটি অসহ্য উপাদান; কারণ শুধু ক্লিব ও আত্মমর্যাদাহীন মানুষের পক্ষেই আত্মপ্রশংসাকে প্রীতিকর জ্ঞান করা সম্ভব। অথচ দেশের বেশির ভাগ রাজনীতিকই এই অশ্রাব্য আকর্ষণে উৎসাহী ও আত্মভ্রষ্ট। মনে রাখা প্রয়োজন, আসলে এতে আদৌ কিছু হয় না, এতে শুধু নিজের কাছে ও অপরের কাছে অকারণে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তোলা হয়; এবং এতে মানুষের কাছে নিজের আত্মসম্মান নষ্ট করা হয় মাত্র। রাজনীতিকদের এটুকু অন্তত বোঝা উচিত, আত্মপ্রশংসা যেহেতু আত্মক্ষয়ের কারণ হয়ে ওঠে, একে পরিহার করাই সর্বতোভাবে বাঞ্ছনীয়। শেখ সাদী রহ: বলেছেনÑ আত্মপ্রশংসা হলো নিজেই নিজেকে আদর করা। এই নিজের কাছে নিজে আদর খাওয়ার ছেলেমি প্রবণতা যদি সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে, তাহলে রাজনীতির ময়দান আর ঘন বিশ্বাসের আবরণে স্নিগ্ধ ও গম্ভীর না থেকে হয়ে ওঠে জনগণের হাসি ও তামাশাস্থল, হয়ে ওঠে একপ্রকার কটু রসে পিচ্ছিল এবং তরল ও আত্মবিলাসী। তাই যারা নিজেকে দেশ এবং জনগণের বিশ্বাস ও নির্ভরতার অকৃত্রিম আশ্রয় বলে মনে করেন, তারা কখনোই তরল এবং পিচ্ছিল ও তামাশালালিত কুহক দিয়ে চালিত হতে পারেন না এবং কোনো ধরনের স্বেচ্ছাকৃত ও স্বসৃষ্ট অপঘাতে আত্মবিসর্জনও দিতে পারেন না। আসলে কথার সংযমে ও মহিমায় যারা হয়ে উঠতে পারেন প্রিয় ও আস্থাশীল এবং মানুষের কাছে প্রণম্য, তুচ্ছ কারণে অর্থাৎ আত্মপ্রশংসার দাসত্ব করতে গিয়ে তারাই হয়ে ওঠেন অনেকটা রসনাবিলাসী বিদূষক। তারা নিজে কোনো ক্ষতি অনুভব করেন কি না জানি না, তবে তাদের এই লোকমজানো উচ্ছ্বাস দেশ ও রাজনীতির জন্য সর্বার্থে অসমীচীন। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, আত্মপ্রশংসার দুর্বার স্রোতে তারা হয়ে ওঠেন প্রতিপক্ষের প্রতি শরনিক্ষেপে এক একজন নিপুণ কিন্তু অসংযমী তীরন্দাজ। অনুমান করি এ থেকে নিজের খুব একটা লাভ হয় না, বরং শরবিদ্ধ প্রতিপক্ষই লাভবান হয়। এটাই নিয়ম, এ রকমই হয়, আঘাত চিরদিনই ফিরে আসে যেখান থেকে তার জন্ম সেখানে। এ জন্যই হজরত আলী রা: বলেছিলেনÑ ‘ওই ব্যক্তি বড় দুর্ভাগা যে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত বিলম্বে করে’।
যা-ই হোক, আর বেশি কথা নয়। এখন অত্যাসন্ন জাতীয় নির্বাচন পূর্ববর্তী যে বিশেষ কথাগুলো ব্যক্ত করা জরুরি সেই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই একটি সমস্যাসঙ্কুল দেশ এবং সমস্যাগুলো এমন, যা ইচ্ছা করলেই পরাভূত করা সম্ভব নয়। ঝড়-জল-বন্যা, ভূমির সীমাবদ্ধতা, সর্বোপরি অস্বাভাবিক জনসংখ্যাÑ সবগুলোই প্রকৃতিগতভাবে এক-একটি স্থায়ী নির্মমতা, যা কোনো চেষ্টা, মেধা ও সংগ্রামের মাধ্যমে দূরীভূত করা অসম্ভব, এমনকি প্রশমিত করাও অসম্ভব। অর্থাৎ এক দুর্নিবার নিয়তি দিয়ে ঘোরতরভাবে আমরা অন্তরীণ। এটা ঠিক, আমাদের কোনো প্রাণঘাতী বহিঃশত্রু নেই। আমাদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে এমন কোনো আগ্রাসী শক্তিও আপাতত দৃশ্যমান নয়। কিন্তু এটাও তো সমধিক সত্য, আমরা নিজেই যদি নিজের শত্রু হয়ে উঠি, সেই সঙ্কট ক্রমাগত ঘনীভূত হয়ে আমাদের অস্তিত্বকে একসময় বিপন্ন করে তুলবেই। এ থেকে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। শুধু ক্ষমতায় থাকা না থাকার প্রশ্ন নয়, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের প্রশ্নও নয়, এই প্রশ্ন টিকে থাকার প্রশ্ন। আর এই টিকে থাকা মানে ক্ষমতায় টিকে থাকা নয়, টিকে থাকার অর্থ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে দেশ ও জনগণকে টিকিয়ে রাখা। বলা দরকার বহিঃশত্রুর আগ্রাসন প্রতিহত করা কঠিন; কিন্তু অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা হেফাজত করা আরো বেশি কঠিন। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরভাগ যদি বিচলিত ও চঞ্চল হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে কারণে-অকারণে শিথিল ও উৎকেন্দ্রিক, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই লঘু বিষয়াদিকে লঘুভাবে বিবেচনা করে রাজনীতিবিদদের সঠিক কর্ম হলো, দেশকে ভ্রাতৃঘাতী তৎপরতা থেকে রক্ষা করা, উৎকেন্দ্রিকতাকে স্তিমিত করে তোলা এবং যেকোনো ধরনের ঈর্ষা ও অসূয়াকে স্তব্ধ করে রাখা।
ইলেকশন আসবে, ধারণা হয় সে ইলেকশনে সব দল অংশ নেবে। এ নিয়ে বেশি শিরপীড়া ও বেশি পেরেশানি বোধ হয় কিছুটা মানসিক বৈকল্যেরই পরিচয় বহন করে। তবে ইলেকশন নিয়ে যে একটা ঘোরতর বিতর্ক দানা বেঁধে উঠছে এটা সুস্পষ্ট। ক্ষমতাসীন দল বলছে, ক্ষমতায় সমাসীন থেকেই নির্বাচন করা হবে এবং তা হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই অধীনে। অন্য দিকে বিএনপি বলছে, নির্বাচন হতে হবে কোনো না কোনোরূপ সহায়ক সরকারের অধীনে, কোনো অবস্থাতেই ‘ব্লু প্রিন্ট’ নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। আর এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন চিন্তামগ্ন হয়ে ভাবছে, এমন দুরূহ অবস্থার মধ্যে কী করে অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যাবে! রোডম্যাপের কিছু সুপারিশ ঘোষণা করার পরেও কমিশন চিন্তামুক্ত হতে পারছে না। ভাবনার কথাই বটে! অবশ্যই আমরা আমাদের মতো ভাবছি। আমরা চাই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক এবং ইনসাফপূর্ণ হোক। এমন ইনসাফ, যা পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবাইকে শান্তি ও স্বস্তি এবং কলহমুক্ত অবস্থার নিশ্চয়তা দিতে পারে। এমন ইনসাফ, যাকে বলা হয়েছে Justice is no justice unless it is divine’। বস্তুতপক্ষে আমাদের সবারই মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি, দেশটা কোনো আলেকজান্ডার বা জুলিয়াস সিজরের দেশ নয়, দেশটা এ দেশের জনগণের দেশ। আর এই জনগণ পর্যাপ্ত বুদ্ধিসম্পন্ন হয়তো নয়, কিন্তু খুব সহজাতভাবেই এটা বুঝতে পারে, কে অকৃত্রিম বন্ধু আর কে আততায়ী, বুঝতে পারে কোনটা চালাকি ও শঠতা, আর কোনটা প্রেম ও মনুষ্যত্বনিষ্ঠা।
২
পূর্ববর্তী আলোচনায় স্থানাভাববশত সব কথা তুলে ধরা যায়নি; ইনসাফের কথা দিয়ে শেষ করেছিলাম। বর্তমান আলোচনাটি আগের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা বিশদভাবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করব। আগেই বলেছি, সীমাহীন ক্ষমতালিপ্সা ও অর্থলোভ, আত্মপ্রশংসা, প্রতিপক্ষের প্রতি অপ্রতিহত ও অভব্য ঈর্ষাকাতরতা, ভারসাম্যহীনতাÑ এই সব কিছু মিলিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ময়দান এমন এক যৌগিক অসমতল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে শুভত্ব ও সুষমা প্রায় অন্তর্হিত এবং এ জন্যই কেউ কেউ সরস ও বিদ্রƒপাত্মক ভঙ্গিতে বলে, বাংলাদেশ বস্তুতপক্ষেই একটি স্বর্ণডিম্বপ্রসবিনী রাজহংস এবং এই হংসের মহিমাগুণেই বহু মানুষ আজ আরব্য-উপন্যাসের অবাক আলাদিন। আমরা মনে মনে শুধু হাসি। কেউ কেউ এমন কথাও বলেন, বাংলাদেশ এক হতভাগিনী কামধেনু, যার বাঁট থেকে দুধ নিঃশেষ হয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে; কিন্তু নির্মম দোহনক্রিয়া কিছুতেই থামছে না। এই কথার পরও আমরা শুধু মনে মনে হাসি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, আমাদের অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত একজন সরলপ্রাণ বয়স্ক ও বিদগ্ধ মানুষ। তিনি অনেক কিছু বোঝেন ও জানেন; সম্ভবত শুধু এইটুকু জানেন না যে, অর্থ-শিকারি মতলবি মানুষেরা মুখে যাই-ই বলুক, তাদের একমাত্র আরাধ্য হলো অর্থ এবং শুধুই অর্থ।
বলাবাহুল্য, ইনসাফ হলো মানবজীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ ও উপজীব্য; তা লঙ্ঘিত কী বিঘিœত হলে জীবনের অর্থ ও সুষমা ফিকে হয়ে আসে ও মিলিয়ে যায়। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গন যদি ইনসাফভ্রষ্ট ও বিবেকবিচ্ছিন্ন পদচারণায় পিষ্ট হতে থাকে, তাহলে সেই ক্ষতি অন্য কোনো সৎকর্ম দ্বারা আদৌ প্রশমিত করা যায় না। আর এই জন্যই যেখানে ইনসাফ আছে সেখানে সবই আছে। যেখানে ইনসাফ নেই সেখানে কিছুই নেই। এটা শতকরা একশত ভাগ সত্য যে, এই ইনসাফ কোনো আত্মপ্রসাদকামী মানুষের লোক দেখানো বস্তু নয়। ইনসাফকে হতে হয় উরারহব এবং এ জন্য ন্যূনতম ইনসাফভ্রষ্টতাও সর্বতোভাবে পরিহার্য। কারণ An injustice anywhere is a threat to justice everywhere’। অর্থাৎ ইনসাফ রক্ষা করার ক্ষেত্রে কণামাত্র অন্যথা হলেও সেটা গুরুতরভাবে আত্মবিনাশকে ত্বরাম্বিত ও অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এ দিক থেকে আমাদের রাজনীতি কি সঠিক ও ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে? দিচ্ছে না। অতএব, যতভাবেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা হোক, রাজনীতির বিস্তীর্ণ পরিসরে ইসনাফের স্থান খুবই সঙ্কীর্ণ। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশ অনিরুদ্ধ সমূহ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য অনুমান করি, আমাদের এই কথায় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কিছু কিছু ব্যক্তি রুষ্ট ও উষ্মাগ্রস্ত হতে পারেন। কিন্তু আমাদের এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই। কারণ সত্য কথা বলার প্রশ্নে নীরবতা অবশ্যই অপরাধ ও অনভিপ্রেত।
আল কুরআনে এই ইনসাফকে বলা হয়েছে মিজান বা ভারসাম্য। জগতে-মহাজগতে এই ভারসাম্য নিখুঁতভাবে বর্তমান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মানুষ তার অসাধু প্রবণতার চাপে ইনসাফকে পদপিষ্ট করার এক দুর্বার আগ্রহ ও উৎসাহ দ্বারা চালিত, যার ফলাফল তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হয়। আমরা ব্যক্ত করতে পারি, পৃথিবীতে যত সমস্যা ও সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা সবই এই ইনসাফ-বিবর্জিত ব্যবস্থাপনার কারণে। অতএব আসন্ন নির্বাচনকে সর্বসম্মত সুষ্ঠুতা দানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে উচিত হবে, অব্যবস্থা ও অসমতল ক্ষেত্রবিন্যাস থেকে যথাসম্ভব দূরে অবস্থান করা এবং নিখুঁতভাবে ‘মিজান’ রক্ষা করা। পরিমিতিবোধ বা ভারসাম্য সঠিকভাবে রক্ষিত না হলে কী হয়, তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো টাইটানিক। এই জাহাজ বরফের গায়ে প্রতিহত হয়ে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় জলমগ্ন হলো এবং ডুবে যাওয়ার জন্য যে সময় লাগার কথা ছিল, তার চেয়ে অনেক কম সময়ে নিমজ্জিত হয়ে যায়। পুরো বিষয়টি গবেষণান্তে জানা গেল, টাইটানিকের বডি নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণাদির যে আনুপাতিক পরিমাণ সঠিক নিয়মে রক্ষা করার কথা, তা রক্ষা করা হয়নি। অর্থাৎ দ্বিখণ্ডিত হয়ে নিমজ্জিত হওয়ার কারণ টাইটানিকের নির্মাণকর্মে পরিমিতির অভাব বা ভারসাম্যহীনতা।
আলোচনা সূত্রে অপর একটি বিষয় উল্লেখ করা অতীব জরুরি। তা হলো বিভেদ ও বৈষম্য। এই বিভেদ ও বৈষম্যহেতু সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে। কারণ বৈষম্য একটি ব্যাধি, যা সব ইতিবাচক দিককে পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত করে দেয় এবং পরিশেষে এমন অবস্থা প্রকট হয়ে ওঠে যে, দেশকে আর একতাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় না। স্মরণ করি, পাকিস্তান যে ভেঙে পড়ল, তার প্রধান কারণ এই বৈষম্য, যা পাকিস্তানকে এমনভাবে রাহুগ্রস্ত করে তুলেছিল যে, ভেঙে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিল না। রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যারা সক্রিয় তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারেন, বৈষম্য শুধু একটি রোগ নয়; এই রোগের প্রভাবে খুব স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয় ক্লেদ ও গ্লানি, হিংসা, কুহক ও অন্ধকার, যা কোনো দেশকে ভেতরে ভেতরে একেবারে ফাঁপা ও রক্তশূন্য করে তোলে।
এখনো সময় আছে; তবু মনে হচ্ছে, নির্বাচন অনেকটা দ্রুতগতিতেই এগিয়ে আসছে। সব দলের মধ্যেই নির্বাচনমুখী তৎপরতা ভালোভাবেই শুরু হয়ে গেছে। যে দল যেভাবে পারছে, তাদের প্রচার ও কর্মকৌশল নিয়ে এখন জনগণের সম্মুখীন। কী হবে না হবে, ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সে কথা আল্লাহ পাক জানেন। আমরা শুধু এইটুকু জানি, কোনো গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তার ভবিষ্যদ্বাণী একেবারেই অর্থহীন। ‘ধন্বন্তরী’ কোনো পাথর পরিধান করাও সমান অর্থহীন। বরং যারা বস্তুনিষ্ঠ গবেষক, যারা দেশ ও জনগণের চিন্তা ও বিশ্বাসের গতিবিধি সম্পর্কে কথঞ্চিৎ ওয়াকিবহাল, তারা হয়তো অগ্রিম কিছু বললেও বলতে পারেন। তবে তাদের ভাবনাকেও অধিক মূল্য দেয়া খুব সমীচীন হবে না; বরং অপেক্ষা করাই শ্রেয়। বস্তুত দেশ শাসনের গুরুভার ও দায়িত্ব কার ওপর অর্পিত হবে, সেটা প্রকৃতপক্ষেই এক রহস্য। কৌতূহল দমন করা কিছুটা কষ্টসাধ্য বটে; কিন্তু রহস্যের আবরণ ছিন্ন করার চেষ্টা আসলেই যেহেতু নিরর্থক ক্লেশ ও শ্রমক্ষয়, এ থেকে দূরে থাকাই উত্তম। বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষ কী চায়, কী তাদের স্বপ্ন ও বিশ্বাস ও প্রত্যাশা, সেই দিকে দৃষ্টিপাত করাই সর্বার্থে কল্যাণকর। জনগণ বেশি কিছু আশা করে না, শুধু এইটুকু চায় যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক এবং এমন সব মানুষ বিজয় মুকুটে শোভিত হোক, যারা সৎ ও নির্ভীক, যারা জনগণের ইচ্ছা ও বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে যথাসময়ে যথোচিত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম। চালাকি দ্বারা সাময়িক জয় লাভ করা যায়, কিন্তু চালাকি যে মুনাফেকির নামান্তর, এটা একসময় প্রমাণ হবেই। অতএব, মানুষ চায় এমন মানুষের বিজয়, কোনো বহিঃশক্তির রক্তচক্ষু বা চতুর স্তাবকতা অথবা অভ্যন্তরীণ হুমকি ও ত্রাস যাকে কণামাত্র বিহ্বল কী বিচলিত করার স্পর্ধা না রাখে, যার কর্তব্যবোধ ও দেশপ্রেম বাক্সময় হয়ে উঠবে বীরত্ব, সাহস, সততা ও দূরদর্শিতা দিয়ে। কবি ইকবাল যথার্থই বলেছেন: ‘সবক্ ফের পড়্ সাদাকাত্ কা আদালত্ কা শুজাবাত্ কা; লে যায়েগা তুঝ্ সে কাম দুনিয়া কা ইমামত কা’Ñ সততা ইনসাফ এবং বীরত্বের পাঠ গ্রহণ করা হলে শুধু দেশ নয়, সমগ্র পৃথিবীই তার নেতৃত্ব বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে এগিয়ে আসবে।
মনে রাখা আবশ্যক, রাজ্য শাসনের ক্ষমতা লাভ করা মহান আল্লাহ পাকের তরফ থেকে প্রদত্ত একটি আমানত। এই আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য। আর যদি তা না হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি বা দল প্রকৃতপক্ষেই নাফরমান-খেয়ানতকারী হিসেবে গণ্য হবে। অতএব, জনগণ চায় এমন একটি নির্বাচন যাকে জনগণ স্বাগত জানাতে পারে, সেটা সংবিধানসম্মতই হোক অথবা অন্য যাই-ই হোক, কোনো কিছুর বিনিময়েই জনগণকে কোনো চালাকির ফাঁদে অবরুদ্ধ রাখা নিঃসন্দেহে খুবই গর্হিত কর্ম। অবশ্য এই সহজ সত্য কথাটি অনেকেই ভুলে থাকতে ভালোবাসেন। এই জন্যই এমন সব মানুষ এগিয়ে আসেন বা এগিয়ে আসার সুযোগ পান, যারা নৈতিক মানদণ্ডে একেবারেই ভীরু ও স্বার্থান্ধ; একেবারেই অসার ও অথর্ব, যারা নিজের কাছেও তরল ও ন্যুব্জ ও আত্মবিভক্ত; অপরের কাছে তো বটেই। বলাবাহুল্য, আসন্ন ভোটযুদ্ধের প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনই আমাদের সর্বশেষ ভরসাস্থল। চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাই আকাশে নানা বর্ণের মেঘের বিক্ষিপ্ত আনাগোনা। বহু অনুচিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা হয়তো ঘটবে, তারপরও আশা রাখতে চাই, সর্বতোমুখী ন্যায্যতা ও ইনসাফ নিশ্চয়ই অক্ষুণœ থাকবে; জাতি নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় একেবারে আশাহত হবে না। দুঃখ ও শঙ্কা-আশঙ্কার কথা একটাই তা হলোÑ পর্যাপ্ত সতর্কতার মধ্যেও ইবলিসের আগমন ঘটে এবং চতুর ও মতলবি তীরন্দাজদের নিশানা কখনোই একেবারে লক্ষচ্যুত হয় না।
লেখক : গীতিকার, সাহিত্যিক
এ বিভাগের আরো কিছু সংবাদ
- সর্বশেষ
- পঠিত
অন্যান্য সংবাদ
-
রাজনীতির নানা কথা ও নির্বাচন কমিশন
-
হাকিম নড়বে; নাকি হুকুম নড়বে?
-
সার্কের দিকেই ভারতকে ফিরতে হবে
-
স্মরণ : বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান
-
ভারত ঘিরে চীনের সমর প্রস্তুতি
-
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কি স্বাভাবিক হতে পারে?
-
বিচারিক স্বাধীনতা : ঠুনকো না সাবলীল
-
নওগাঁর মানুষের আপনজন পোনা ভাই
-
ষোড়শ সংশোধনী : রাজনীতির নয়া উপকরণ
-
কোটার ফাঁদ
১
একদা মূষিক বর্তমানে বিশালবপু ঐরাবত, এ রকম ঐরাবতরূপী ধনাঢ্য মানুষের সংখ্যা অনেক নয়, অসংখ্য। রাজনীতির তৃণমূল থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত এ ধরনের ভাগ্যবান ঐরাবত সর্বত্রই পরিদৃশ্যমান। অবশ্য এটা সত্য, চোখে পড়ার মতো কিছু ব্যতিক্রমও আছে। কিন্তু দুঃখ হলো, সক্রিয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও যারা আর্থিকভাবে সৎ ও দরিদ্র, ক্ষমতার ভেতরে-বাইরে যেখানেই অবস্থান করুন, তাদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য। অবশ্য এ সাথে উল্লেখ করি, এই নির্লোভ নগণ্য পুরুষেরাই আমাদের গৌরব ও অহঙ্কার, যারা ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন মূর্খের’ মতো অর্থলোভকে পরাভূত করতে সক্ষম, যারা নিজেকে ও রাজনীতিকে কুৎসিত ভ্রান্তিবিলাস থেকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।
যা-ই হোক, যে বিষয়টি শুরুতেই উল্লেখ করব বলে ভাবছি তাহলো, দেশের রাজনীতি যদি ক্ষমতালোভ ও অর্থলিপ্সার করুণ শিকারে পরিণত হয়, তাহলে দেশ ও দেশের রাজনীতি নানা অনুচিত উপচ্ছায়া ও উপসর্গ দিয়ে আক্রান্ত হবে সেটাই স্বাভাবিক, শুধু স্বাভাবিক নয়, রীতিমতো অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী। বস্তুত তাই-ই হয়েছে। যে কারণে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে উচ্চকণ্ঠ ফাঁকা আওয়াজ যতটা শোনা যায়, তার এক শতাংশও স্বচ্ছতা ও আত্মনিষ্ঠার পরিচয় মেলে না। রাজনীতি হয়ে ওঠে অসূয়া বিদ্বেষ গ্লানি ও পরস্পরের প্রতি সীমাহীন দুশমনির আধার, অনেকটা যেন গ্রিক-গ্লাডিয়েটরদের সদম্ভ পদভারে কম্পমান মল্লভূমি। শুধু তাই নয়, এমনকি রাজনীতির ভাষাও হয়ে ওঠে শিষ্টাচারবর্জিত অভব্য ও আক্রমণাত্মক। এ এক মহা সঙ্কট, যাকে রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য সহচর হিসেবে মেনে নেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অপর একটি উৎকট সমস্যা হলো আত্মপ্রশংসা। চাটুকারিতা কি স্তাবকতা কথঞ্চিৎ সহনীয়, কিন্তু আত্মপ্রশংসা একেবারেই একটি অসহ্য উপাদান; কারণ শুধু ক্লিব ও আত্মমর্যাদাহীন মানুষের পক্ষেই আত্মপ্রশংসাকে প্রীতিকর জ্ঞান করা সম্ভব। অথচ দেশের বেশির ভাগ রাজনীতিকই এই অশ্রাব্য আকর্ষণে উৎসাহী ও আত্মভ্রষ্ট। মনে রাখা প্রয়োজন, আসলে এতে আদৌ কিছু হয় না, এতে শুধু নিজের কাছে ও অপরের কাছে অকারণে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তোলা হয়; এবং এতে মানুষের কাছে নিজের আত্মসম্মান নষ্ট করা হয় মাত্র। রাজনীতিকদের এটুকু অন্তত বোঝা উচিত, আত্মপ্রশংসা যেহেতু আত্মক্ষয়ের কারণ হয়ে ওঠে, একে পরিহার করাই সর্বতোভাবে বাঞ্ছনীয়। শেখ সাদী রহ: বলেছেনÑ আত্মপ্রশংসা হলো নিজেই নিজেকে আদর করা। এই নিজের কাছে নিজে আদর খাওয়ার ছেলেমি প্রবণতা যদি সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে, তাহলে রাজনীতির ময়দান আর ঘন বিশ্বাসের আবরণে স্নিগ্ধ ও গম্ভীর না থেকে হয়ে ওঠে জনগণের হাসি ও তামাশাস্থল, হয়ে ওঠে একপ্রকার কটু রসে পিচ্ছিল এবং তরল ও আত্মবিলাসী। তাই যারা নিজেকে দেশ এবং জনগণের বিশ্বাস ও নির্ভরতার অকৃত্রিম আশ্রয় বলে মনে করেন, তারা কখনোই তরল এবং পিচ্ছিল ও তামাশালালিত কুহক দিয়ে চালিত হতে পারেন না এবং কোনো ধরনের স্বেচ্ছাকৃত ও স্বসৃষ্ট অপঘাতে আত্মবিসর্জনও দিতে পারেন না। আসলে কথার সংযমে ও মহিমায় যারা হয়ে উঠতে পারেন প্রিয় ও আস্থাশীল এবং মানুষের কাছে প্রণম্য, তুচ্ছ কারণে অর্থাৎ আত্মপ্রশংসার দাসত্ব করতে গিয়ে তারাই হয়ে ওঠেন অনেকটা রসনাবিলাসী বিদূষক। তারা নিজে কোনো ক্ষতি অনুভব করেন কি না জানি না, তবে তাদের এই লোকমজানো উচ্ছ্বাস দেশ ও রাজনীতির জন্য সর্বার্থে অসমীচীন। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, আত্মপ্রশংসার দুর্বার স্রোতে তারা হয়ে ওঠেন প্রতিপক্ষের প্রতি শরনিক্ষেপে এক একজন নিপুণ কিন্তু অসংযমী তীরন্দাজ। অনুমান করি এ থেকে নিজের খুব একটা লাভ হয় না, বরং শরবিদ্ধ প্রতিপক্ষই লাভবান হয়। এটাই নিয়ম, এ রকমই হয়, আঘাত চিরদিনই ফিরে আসে যেখান থেকে তার জন্ম সেখানে। এ জন্যই হজরত আলী রা: বলেছিলেনÑ ‘ওই ব্যক্তি বড় দুর্ভাগা যে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত বিলম্বে করে’।
যা-ই হোক, আর বেশি কথা নয়। এখন অত্যাসন্ন জাতীয় নির্বাচন পূর্ববর্তী যে বিশেষ কথাগুলো ব্যক্ত করা জরুরি সেই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই একটি সমস্যাসঙ্কুল দেশ এবং সমস্যাগুলো এমন, যা ইচ্ছা করলেই পরাভূত করা সম্ভব নয়। ঝড়-জল-বন্যা, ভূমির সীমাবদ্ধতা, সর্বোপরি অস্বাভাবিক জনসংখ্যাÑ সবগুলোই প্রকৃতিগতভাবে এক-একটি স্থায়ী নির্মমতা, যা কোনো চেষ্টা, মেধা ও সংগ্রামের মাধ্যমে দূরীভূত করা অসম্ভব, এমনকি প্রশমিত করাও অসম্ভব। অর্থাৎ এক দুর্নিবার নিয়তি দিয়ে ঘোরতরভাবে আমরা অন্তরীণ। এটা ঠিক, আমাদের কোনো প্রাণঘাতী বহিঃশত্রু নেই। আমাদের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে এমন কোনো আগ্রাসী শক্তিও আপাতত দৃশ্যমান নয়। কিন্তু এটাও তো সমধিক সত্য, আমরা নিজেই যদি নিজের শত্রু হয়ে উঠি, সেই সঙ্কট ক্রমাগত ঘনীভূত হয়ে আমাদের অস্তিত্বকে একসময় বিপন্ন করে তুলবেই। এ থেকে নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। শুধু ক্ষমতায় থাকা না থাকার প্রশ্ন নয়, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের প্রশ্নও নয়, এই প্রশ্ন টিকে থাকার প্রশ্ন। আর এই টিকে থাকা মানে ক্ষমতায় টিকে থাকা নয়, টিকে থাকার অর্থ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে দেশ ও জনগণকে টিকিয়ে রাখা। বলা দরকার বহিঃশত্রুর আগ্রাসন প্রতিহত করা কঠিন; কিন্তু অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা হেফাজত করা আরো বেশি কঠিন। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরভাগ যদি বিচলিত ও চঞ্চল হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে কারণে-অকারণে শিথিল ও উৎকেন্দ্রিক, তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই লঘু বিষয়াদিকে লঘুভাবে বিবেচনা করে রাজনীতিবিদদের সঠিক কর্ম হলো, দেশকে ভ্রাতৃঘাতী তৎপরতা থেকে রক্ষা করা, উৎকেন্দ্রিকতাকে স্তিমিত করে তোলা এবং যেকোনো ধরনের ঈর্ষা ও অসূয়াকে স্তব্ধ করে রাখা।
ইলেকশন আসবে, ধারণা হয় সে ইলেকশনে সব দল অংশ নেবে। এ নিয়ে বেশি শিরপীড়া ও বেশি পেরেশানি বোধ হয় কিছুটা মানসিক বৈকল্যেরই পরিচয় বহন করে। তবে ইলেকশন নিয়ে যে একটা ঘোরতর বিতর্ক দানা বেঁধে উঠছে এটা সুস্পষ্ট। ক্ষমতাসীন দল বলছে, ক্ষমতায় সমাসীন থেকেই নির্বাচন করা হবে এবং তা হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই অধীনে। অন্য দিকে বিএনপি বলছে, নির্বাচন হতে হবে কোনো না কোনোরূপ সহায়ক সরকারের অধীনে, কোনো অবস্থাতেই ‘ব্লু প্রিন্ট’ নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। আর এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন চিন্তামগ্ন হয়ে ভাবছে, এমন দুরূহ অবস্থার মধ্যে কী করে অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যাবে! রোডম্যাপের কিছু সুপারিশ ঘোষণা করার পরেও কমিশন চিন্তামুক্ত হতে পারছে না। ভাবনার কথাই বটে! অবশ্যই আমরা আমাদের মতো ভাবছি। আমরা চাই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক এবং ইনসাফপূর্ণ হোক। এমন ইনসাফ, যা পক্ষ-প্রতিপক্ষ সবাইকে শান্তি ও স্বস্তি এবং কলহমুক্ত অবস্থার নিশ্চয়তা দিতে পারে। এমন ইনসাফ, যাকে বলা হয়েছে Justice is no justice unless it is divine’। বস্তুতপক্ষে আমাদের সবারই মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি, দেশটা কোনো আলেকজান্ডার বা জুলিয়াস সিজরের দেশ নয়, দেশটা এ দেশের জনগণের দেশ। আর এই জনগণ পর্যাপ্ত বুদ্ধিসম্পন্ন হয়তো নয়, কিন্তু খুব সহজাতভাবেই এটা বুঝতে পারে, কে অকৃত্রিম বন্ধু আর কে আততায়ী, বুঝতে পারে কোনটা চালাকি ও শঠতা, আর কোনটা প্রেম ও মনুষ্যত্বনিষ্ঠা।
২
পূর্ববর্তী আলোচনায় স্থানাভাববশত সব কথা তুলে ধরা যায়নি; ইনসাফের কথা দিয়ে শেষ করেছিলাম। বর্তমান আলোচনাটি আগের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুটা বিশদভাবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করব। আগেই বলেছি, সীমাহীন ক্ষমতালিপ্সা ও অর্থলোভ, আত্মপ্রশংসা, প্রতিপক্ষের প্রতি অপ্রতিহত ও অভব্য ঈর্ষাকাতরতা, ভারসাম্যহীনতাÑ এই সব কিছু মিলিয়ে আমাদের রাজনৈতিক ময়দান এমন এক যৌগিক অসমতল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে শুভত্ব ও সুষমা প্রায় অন্তর্হিত এবং এ জন্যই কেউ কেউ সরস ও বিদ্রƒপাত্মক ভঙ্গিতে বলে, বাংলাদেশ বস্তুতপক্ষেই একটি স্বর্ণডিম্বপ্রসবিনী রাজহংস এবং এই হংসের মহিমাগুণেই বহু মানুষ আজ আরব্য-উপন্যাসের অবাক আলাদিন। আমরা মনে মনে শুধু হাসি। কেউ কেউ এমন কথাও বলেন, বাংলাদেশ এক হতভাগিনী কামধেনু, যার বাঁট থেকে দুধ নিঃশেষ হয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে; কিন্তু নির্মম দোহনক্রিয়া কিছুতেই থামছে না। এই কথার পরও আমরা শুধু মনে মনে হাসি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, আমাদের অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত একজন সরলপ্রাণ বয়স্ক ও বিদগ্ধ মানুষ। তিনি অনেক কিছু বোঝেন ও জানেন; সম্ভবত শুধু এইটুকু জানেন না যে, অর্থ-শিকারি মতলবি মানুষেরা মুখে যাই-ই বলুক, তাদের একমাত্র আরাধ্য হলো অর্থ এবং শুধুই অর্থ।
বলাবাহুল্য, ইনসাফ হলো মানবজীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ ও উপজীব্য; তা লঙ্ঘিত কী বিঘিœত হলে জীবনের অর্থ ও সুষমা ফিকে হয়ে আসে ও মিলিয়ে যায়। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গন যদি ইনসাফভ্রষ্ট ও বিবেকবিচ্ছিন্ন পদচারণায় পিষ্ট হতে থাকে, তাহলে সেই ক্ষতি অন্য কোনো সৎকর্ম দ্বারা আদৌ প্রশমিত করা যায় না। আর এই জন্যই যেখানে ইনসাফ আছে সেখানে সবই আছে। যেখানে ইনসাফ নেই সেখানে কিছুই নেই। এটা শতকরা একশত ভাগ সত্য যে, এই ইনসাফ কোনো আত্মপ্রসাদকামী মানুষের লোক দেখানো বস্তু নয়। ইনসাফকে হতে হয় উরারহব এবং এ জন্য ন্যূনতম ইনসাফভ্রষ্টতাও সর্বতোভাবে পরিহার্য। কারণ An injustice anywhere is a threat to justice everywhere’। অর্থাৎ ইনসাফ রক্ষা করার ক্ষেত্রে কণামাত্র অন্যথা হলেও সেটা গুরুতরভাবে আত্মবিনাশকে ত্বরাম্বিত ও অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এ দিক থেকে আমাদের রাজনীতি কি সঠিক ও ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে? দিচ্ছে না। অতএব, যতভাবেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা হোক, রাজনীতির বিস্তীর্ণ পরিসরে ইসনাফের স্থান খুবই সঙ্কীর্ণ। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দেশ অনিরুদ্ধ সমূহ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য অনুমান করি, আমাদের এই কথায় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কিছু কিছু ব্যক্তি রুষ্ট ও উষ্মাগ্রস্ত হতে পারেন। কিন্তু আমাদের এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই। কারণ সত্য কথা বলার প্রশ্নে নীরবতা অবশ্যই অপরাধ ও অনভিপ্রেত।
আল কুরআনে এই ইনসাফকে বলা হয়েছে মিজান বা ভারসাম্য। জগতে-মহাজগতে এই ভারসাম্য নিখুঁতভাবে বর্তমান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মানুষ তার অসাধু প্রবণতার চাপে ইনসাফকে পদপিষ্ট করার এক দুর্বার আগ্রহ ও উৎসাহ দ্বারা চালিত, যার ফলাফল তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হয়। আমরা ব্যক্ত করতে পারি, পৃথিবীতে যত সমস্যা ও সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা সবই এই ইনসাফ-বিবর্জিত ব্যবস্থাপনার কারণে। অতএব আসন্ন নির্বাচনকে সর্বসম্মত সুষ্ঠুতা দানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে উচিত হবে, অব্যবস্থা ও অসমতল ক্ষেত্রবিন্যাস থেকে যথাসম্ভব দূরে অবস্থান করা এবং নিখুঁতভাবে ‘মিজান’ রক্ষা করা। পরিমিতিবোধ বা ভারসাম্য সঠিকভাবে রক্ষিত না হলে কী হয়, তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো টাইটানিক। এই জাহাজ বরফের গায়ে প্রতিহত হয়ে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় জলমগ্ন হলো এবং ডুবে যাওয়ার জন্য যে সময় লাগার কথা ছিল, তার চেয়ে অনেক কম সময়ে নিমজ্জিত হয়ে যায়। পুরো বিষয়টি গবেষণান্তে জানা গেল, টাইটানিকের বডি নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণাদির যে আনুপাতিক পরিমাণ সঠিক নিয়মে রক্ষা করার কথা, তা রক্ষা করা হয়নি। অর্থাৎ দ্বিখণ্ডিত হয়ে নিমজ্জিত হওয়ার কারণ টাইটানিকের নির্মাণকর্মে পরিমিতির অভাব বা ভারসাম্যহীনতা।
আলোচনা সূত্রে অপর একটি বিষয় উল্লেখ করা অতীব জরুরি। তা হলো বিভেদ ও বৈষম্য। এই বিভেদ ও বৈষম্যহেতু সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে। কারণ বৈষম্য একটি ব্যাধি, যা সব ইতিবাচক দিককে পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত করে দেয় এবং পরিশেষে এমন অবস্থা প্রকট হয়ে ওঠে যে, দেশকে আর একতাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় না। স্মরণ করি, পাকিস্তান যে ভেঙে পড়ল, তার প্রধান কারণ এই বৈষম্য, যা পাকিস্তানকে এমনভাবে রাহুগ্রস্ত করে তুলেছিল যে, ভেঙে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিল না। রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যারা সক্রিয় তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারেন, বৈষম্য শুধু একটি রোগ নয়; এই রোগের প্রভাবে খুব স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয় ক্লেদ ও গ্লানি, হিংসা, কুহক ও অন্ধকার, যা কোনো দেশকে ভেতরে ভেতরে একেবারে ফাঁপা ও রক্তশূন্য করে তোলে।
এখনো সময় আছে; তবু মনে হচ্ছে, নির্বাচন অনেকটা দ্রুতগতিতেই এগিয়ে আসছে। সব দলের মধ্যেই নির্বাচনমুখী তৎপরতা ভালোভাবেই শুরু হয়ে গেছে। যে দল যেভাবে পারছে, তাদের প্রচার ও কর্মকৌশল নিয়ে এখন জনগণের সম্মুখীন। কী হবে না হবে, ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সে কথা আল্লাহ পাক জানেন। আমরা শুধু এইটুকু জানি, কোনো গণক বা ভবিষ্যদ্বক্তার ভবিষ্যদ্বাণী একেবারেই অর্থহীন। ‘ধন্বন্তরী’ কোনো পাথর পরিধান করাও সমান অর্থহীন। বরং যারা বস্তুনিষ্ঠ গবেষক, যারা দেশ ও জনগণের চিন্তা ও বিশ্বাসের গতিবিধি সম্পর্কে কথঞ্চিৎ ওয়াকিবহাল, তারা হয়তো অগ্রিম কিছু বললেও বলতে পারেন। তবে তাদের ভাবনাকেও অধিক মূল্য দেয়া খুব সমীচীন হবে না; বরং অপেক্ষা করাই শ্রেয়। বস্তুত দেশ শাসনের গুরুভার ও দায়িত্ব কার ওপর অর্পিত হবে, সেটা প্রকৃতপক্ষেই এক রহস্য। কৌতূহল দমন করা কিছুটা কষ্টসাধ্য বটে; কিন্তু রহস্যের আবরণ ছিন্ন করার চেষ্টা আসলেই যেহেতু নিরর্থক ক্লেশ ও শ্রমক্ষয়, এ থেকে দূরে থাকাই উত্তম। বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষ কী চায়, কী তাদের স্বপ্ন ও বিশ্বাস ও প্রত্যাশা, সেই দিকে দৃষ্টিপাত করাই সর্বার্থে কল্যাণকর। জনগণ বেশি কিছু আশা করে না, শুধু এইটুকু চায় যে, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক এবং এমন সব মানুষ বিজয় মুকুটে শোভিত হোক, যারা সৎ ও নির্ভীক, যারা জনগণের ইচ্ছা ও বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে যথাসময়ে যথোচিত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম। চালাকি দ্বারা সাময়িক জয় লাভ করা যায়, কিন্তু চালাকি যে মুনাফেকির নামান্তর, এটা একসময় প্রমাণ হবেই। অতএব, মানুষ চায় এমন মানুষের বিজয়, কোনো বহিঃশক্তির রক্তচক্ষু বা চতুর স্তাবকতা অথবা অভ্যন্তরীণ হুমকি ও ত্রাস যাকে কণামাত্র বিহ্বল কী বিচলিত করার স্পর্ধা না রাখে, যার কর্তব্যবোধ ও দেশপ্রেম বাক্সময় হয়ে উঠবে বীরত্ব, সাহস, সততা ও দূরদর্শিতা দিয়ে। কবি ইকবাল যথার্থই বলেছেন: ‘সবক্ ফের পড়্ সাদাকাত্ কা আদালত্ কা শুজাবাত্ কা; লে যায়েগা তুঝ্ সে কাম দুনিয়া কা ইমামত কা’Ñ সততা ইনসাফ এবং বীরত্বের পাঠ গ্রহণ করা হলে শুধু দেশ নয়, সমগ্র পৃথিবীই তার নেতৃত্ব বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে এগিয়ে আসবে।
মনে রাখা আবশ্যক, রাজ্য শাসনের ক্ষমতা লাভ করা মহান আল্লাহ পাকের তরফ থেকে প্রদত্ত একটি আমানত। এই আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য। আর যদি তা না হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি বা দল প্রকৃতপক্ষেই নাফরমান-খেয়ানতকারী হিসেবে গণ্য হবে। অতএব, জনগণ চায় এমন একটি নির্বাচন যাকে জনগণ স্বাগত জানাতে পারে, সেটা সংবিধানসম্মতই হোক অথবা অন্য যাই-ই হোক, কোনো কিছুর বিনিময়েই জনগণকে কোনো চালাকির ফাঁদে অবরুদ্ধ রাখা নিঃসন্দেহে খুবই গর্হিত কর্ম। অবশ্য এই সহজ সত্য কথাটি অনেকেই ভুলে থাকতে ভালোবাসেন। এই জন্যই এমন সব মানুষ এগিয়ে আসেন বা এগিয়ে আসার সুযোগ পান, যারা নৈতিক মানদণ্ডে একেবারেই ভীরু ও স্বার্থান্ধ; একেবারেই অসার ও অথর্ব, যারা নিজের কাছেও তরল ও ন্যুব্জ ও আত্মবিভক্ত; অপরের কাছে তো বটেই। বলাবাহুল্য, আসন্ন ভোটযুদ্ধের প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনই আমাদের সর্বশেষ ভরসাস্থল। চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাই আকাশে নানা বর্ণের মেঘের বিক্ষিপ্ত আনাগোনা। বহু অনুচিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা হয়তো ঘটবে, তারপরও আশা রাখতে চাই, সর্বতোমুখী ন্যায্যতা ও ইনসাফ নিশ্চয়ই অক্ষুণœ থাকবে; জাতি নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় একেবারে আশাহত হবে না। দুঃখ ও শঙ্কা-আশঙ্কার কথা একটাই তা হলোÑ পর্যাপ্ত সতর্কতার মধ্যেও ইবলিসের আগমন ঘটে এবং চতুর ও মতলবি তীরন্দাজদের নিশানা কখনোই একেবারে লক্ষচ্যুত হয় না।
লেখক : গীতিকার, সাহিত্যিক
No comments