সত্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা!
বেতাগীর
স্কুলে শিক্ষককে ধর্ষণের ঘটনার ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
তাঁকে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এই ডাক্তারি পরীক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ
হয়েছে। সত্য
চাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে।
ধর্ষণের শিকার শিক্ষক এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। গতকাল রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এটা অসম্ভব। যদি এটা হয়, তাহলে বলব, ফলাফল উল্টে দেওয়া হয়েছে। আমি শতভাগ নিশ্চিত, পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত প্রমাণিত হবে।’
বরগুনার বেতাগী উপজেলায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই
সহকারী শিক্ষককে (৩০) গত বৃহস্পতিবার স্কুলের একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে
রেখে ধর্ষণ করা হয়। ওই সময় তাঁর স্বামীকে মারধর করে আটকে রাখা হয়। ওই দিন
রাতেই ছয় যুবককে আসামি করে বেতাগী থানায় মামলা করেন ওই শিক্ষক।
এ ঘটনায় ধর্ষণের আলামত পরীক্ষার পর গতকাল প্রতিবেদন জমা
দেন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক আজমিরি বেগম। এ বিষয়ে
জানতে চাইলে আজমিরি বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধর্ষণের বিষয়ে নারীর
পারিপার্শ্বিক নানা বিষয় জড়িত থাকে। এ জন্য এটা ধর্ষণ কি না, সে বিষয়ে আমি
মন্তব্য করতে পারব না। তবে তাঁর হাতে ও গালে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।’
আলামত পরীক্ষাকারী এই চিকিৎসক গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘পরীক্ষায় সম্ভবত ধর্ষণের আলামত মিলেছে।’
প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বরগুনার সিভিল সার্জন জসিম উদ্দিন হাওলাদার গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে
বলেন, শিক্ষিকাকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া না গেলেও তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা করা
হতে পারে। কারণ, ওই শিক্ষিকার হাতে ও গালে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
গতকাল দুপুরে ওই শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে পুলিশি পাহারা দেখা
যায়। নির্যাতনের শিকার শিক্ষক বলেন, ‘ওরা আমার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করেছে।
পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শরীরজুড়ে যন্ত্রণা। আমি আর কিছু বলতে চাই
না।’ ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত না পাওয়ার কথা জানানো হলে তিনি বলেন,
‘অসম্ভব, এটা হতে পারে না।’
ওই শিক্ষকের বাবা বললেন, ‘এত বড় একটা অন্যায় হয়ে গেল
মেয়েটার ওপর। আমরা কি বিচার পাব? কে বিচার করবে? কার কাছে বিচার চাইব?
ঘটনার পর থেকে মেয়েটা কোনো দানাপানি মুখে দিচ্ছে না, রাতে ঘুমাতে পারছে না,
একটু তন্দ্রায় পড়লে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। চারদিকে ভয় আর আতঙ্ক। পুলিশ
পাহারা দিলেও আমাদের আতঙ্ক তো কমছে না।’
সত্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা, শিক্ষকদের প্রতিবাদ
স্থানীয় শিক্ষক সমিতির নেতা, শিক্ষকের পরিবার ও এলাকার সচেতন মহলও এই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আসল
সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে অপরাধীদের রক্ষার জন্য ধর্ষণের আলামত গোপন করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বেতাগী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে অপরাধীদের রক্ষার জন্য ধর্ষণের আলামত গোপন করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বেতাগী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রতিবেশী বললেন, ঘটনাটি
ধামাচাপা দিতে একটি প্রভাবশালী মহল নেপথ্যে কাজ করছে। এ জন্য শিক্ষকের
পরিবারটি ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। কারণ, প্রশাসনের কেউ কেউ ওই মহলের সঙ্গে
আছেন।
বেতাগী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতারা পুনরায় আলামত
পরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন। এর প্রতিবাদে আজ থেকে পরপর তিন দিন সব শিক্ষক
কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। এ ছাড়া ২২ আগস্ট বেলা ১১টায় মানববন্ধন কর্মসূচি ও
স্মারকলিপি পেশ করবেন তাঁরা। ওই দিন তাঁরা জেলাব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি
ঘোষণা করবেন। এরপরও যদি আসামিদের গ্রেপ্তার ও সুষ্ঠু প্রতিবেদন দেওয়া না
হয়, তাহলে দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দেওয়ার ঘোষণা দেবেন তাঁরা।
উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে
বলেন, ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে
এটাকে পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি পুনরায় ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত
ঘটনা উদ্ঘাটনের দাবি জানান।
বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও হোসনাবাদ
ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাকসুদুল আলম বলেন, ‘একটি মহল শুরু থেকেই এ ঘটনা
ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এত বড় একটি ঘটনা যেখানে ঘটল, সেখানে ডাক্তারি
পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেল না, এটা বিস্ময়কর ও সন্দেহজনক। এটা
কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
এদিকে গণধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার ছয় আসামির মধ্যে ৬
নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম গতকাল বেতাগী থানায় আত্মসমর্পণ করেছেন। শনিবার
রবিউলের বাবা সুলতান মিয়াকে পুলিশ আটক করার পর ছেলেকে এনে দেওয়ার মুচলেকা
দিয়ে তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন। অন্য পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
গতকাল সকালে পুলিশের বরিশাল বিভাগীয় অতিরিক্ত
উপমহাপরিদর্শক আকরাম হোসেন ওই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার জন্য বিদ্যালয়ে যান।
এ সময় জেলা পুলিশ সুপার বিজয় বসাক তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
ধর্ষণের শিকার শিক্ষক মামলায় উল্লেখ করেছেন, বিদ্যালয়
ছুটির পর বেলা আড়াইটার দিকে তাঁর স্বামী তাঁকে আনার জন্য বিদ্যালয়ে যান। এ
সময় এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী সুমন বিশ্বাস, রাসেল, জুয়েল, সুমন, রেজাউল,
হাসান ও রবিউল বিদ্যালয়ে যায়। তারা তাঁর স্বামীকে মারধর করে আটকে রেখে
তাঁকে ধর্ষণ করে।
বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক গতকাল প্রথম আলোকে
বলেন, মামলাটি অধিক গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। মেডিকেল প্রতিবেদনের
বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আদালতের ব্যাপার। এ বিষয়ে আমি কোনো
মন্তব্য করতে চাই না। এলাকার লোকজন এ নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করতে পারেন,
সেটা তাঁদের ব্যাপার।’
No comments