Breaking News

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগার : টাকা হলে যেখানে সব মেলে

কারাগারে কার সাথে দেখা করবেন তাড়াতাড়ি নাম-ঠিকানা বলে ফেলেন। সরাসরি নাকি জানালা দিয়ে। সরাসরি হলে ৫ শ’ টাকা আর জানালা দিয়ে সাধারণ দেখা করলে ১ শ’ টাকার স্লিপ কাটতে হবে। তবে আরো একটি পদ্ধতি রয়েছে। তা হলো ১০ টাকার স্লিপ। এ পদ্ধতিতে দেখা করতে চাইলে বলে দেয়া হয়, আপনাকে এক ঘণ্টা পরে আসতে হবে। কারণ ওই স্লিপ লেখার লোক এখন নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে এ ধরনের অনিয়ম হচ্ছে প্রকাশ্যে।


সেখানে বন্দীরা কেমন আছেন তা সরেজমিনে খোঁজ নিতে গেলে নির্মাণাধীন একটি ঘরের মধ্যে দানবাক্সের ওপর টেবিল-চেয়ার পেতে দুই কারারক্ষীকে প্রকাশ্যেই দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলতে দেখা যায়। দর্শনার্থীরা দূর-দূরান্ত থেকে আসায় তারা বাধ্য হয়েই চাহিদামাফিক টাকা দিয়ে দেখা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারে বুধবার (১৬ আগস্ট) পর্যন্ত এক হাজারের মতো বন্দী অবস্থান করছিল। এসব বন্দীর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ আসামিই মাদক মামলার। এ কারণে মাঝে মধ্যে কারাগারে অসুস্থ হয়ে বন্দী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ শফিকুর রহমান (৪৫) নামে এক হাজতিকে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে নিহতের পরিবার থেকে শফিকুলের মৃত্যুকে নির্যাতনে মারা যাওয়ার অভিযোগ তোলেন। এমন অভিযোগের পর কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি চেপে রাখার চেষ্টা করেন বলে কাউতলী এলাকার মানুষের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে। এ ছাড়া কারাগারে সরকারি বরাদ্দের যে ভাত, মাছ, সবজি ও ডাল প্রতিদিন বন্দীদের দেয়া হচ্ছে তার বেশির ভাগই নি¤œমানের বলে স্বজনেরা অভিযোগ করছেন। আর সিট বাণিজ্যের অভিযোগ তো আছেই। তবে কারাগারের ভেতরে এবং বাইরের পরিবেশ ভালো।

সকাল ১০টায় কারাগারে এ প্রতিবেদক প্রবেশ করতে গেলে গেটেই কারারক্ষী হাসান পাশের কক্ষে ৫ টাকার বিনিময়ে মোবাইল ফোন রেখে যেতে বলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোবাইল নিয়ে ভেতরে ঢুকে বন্দীর সাথে স্বজনেরা বাইরে কথা বলিয়ে দেয়। এ কারণে মোবাইল নেয়া নিষেধ। কারাভ্যন্তরে প্রবেশের পর মূল গেটের পাশেই সাক্ষাৎ কক্ষ। পাশের রুমে টেবিল-চেয়ার পেতে বসে আছেন সাহালান ও মোস্তফা নামে দুই কারারক্ষী।
পরিচয় গোপন রেখে গেলে চেয়ারে বসা মোস্তফা কয়েদির নাম-ঠিকানা জানতে চেয়ে বলেন, ১ শ’ নাকি ৫ শ’ টাকার স্লিপ কাটব। ১০ টাকার টিকিটে দেখা করব জানালে তখন তিনি বলেন, ১০ টাকার স্লিপে দেখা করতে হলে আপনাকে বেলা ১২টার পর আসতে হবে। এ সময় দেখা যায়, কারারক্ষীরা যে বাক্সের ওপর বসে স্লিপ লিখছেন সেই বাক্সের এক পাশে লেখা ‘মসজিদের দানবাক্স’। ১০ টাকা দিয়েই দেখা করব এমন কথা বলে কারাগারের পূর্ব পাশের কারা বেকারি ও মিনি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায় সেখান থেকে বন্দীর জন্য স্বজনেরা প্রয়োজনীয় পণ্য ও বিড়ি-সিগারেট ক্রয় করছেন। ওই দোকানে কর্তব্যরত কারারক্ষী কথা প্রসঙ্গে বলেন, এই কারাগারে যত আসামি আছে তার ৭০ ভাগ বন্দী মাদক মামলার আসামি। এর মধ্যে মারামারিসহ অন্যান্য মামলার আসামিও আছে।
এত মাদক মামলার আসামিকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে জানতে চাইলে অপর এক কারারক্ষী বলেন, এগুলো আমাদের সবসময় কন্ট্রোলের মধ্যে থাকে। তবে মাদক মামলার এসব আসামিকে সংশোধনের জন্য কারাগারের ভেতরে বিভিন্ন কর্মসূচি কর্তৃপক্ষ হাতে নিয়েছে। তবে সেটি খুব অপ্রতুল।

সাক্ষাৎ কক্ষে ঢুকে দেখা যায় বন্দীর সাথে স্বজনেরা কথা বলছেন। কেউ আবার অপেক্ষা করছেন বন্দী আসার জন্য। এক ব্যক্তি এ সময় বলেন, ভেতরে গণনা চলছে। তাই আমার লোক আসছে না। এ সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয় থেকে আসা এক ব্যক্তি বলতে থাকেন, এই কারাগারে এখন ফ্রি স্টাইলে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। টাকা ছাড়া কেউ সাক্ষাৎ করতেই পারে না। ১০ টাকার টিকিট কাটলে লোক ভেতর থেকে আসে না। এসব কি কেউ দেখেন না? সরেজমিন পরিদর্শন শেষে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় দেখা যায়, এক ব্যক্তি মোটরসাইকেল নিয়ে কারাগারে ভেতরে প্রবেশ করছেন। তার সাথের ব্যক্তি মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে ঢুকছেন। কর্তব্যরত কারারক্ষীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওদের মোবাইল রাখার কথা বলতে গেলে আমার চাকরিই থাকব না! ওনারা হচ্ছেন সুপার, জেলার স্যারের লোক।’

কারাগারের বাইরে অপেক্ষমাণ এক নারী নাম না প্রকাশের শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার স্বামী দুবাই থাকত। গত ২০ দিন আগে এ কারাগারে এসেছে। দুই বছর আগে মারামারির মামলা হলেও আমার স্বামী আদালতে হাজির না হয়ে জামিন নিয়ে বিদেশ চলে গিয়েছিল। এতে ওয়ারেন্ট বের হয়ে যায়। দেশে এলে পুলিশ তাকে ধরে জেলে পাঠায়। এখন সে এই কারাগারে আছে। ভেতরে কেমন আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারাগারে কেমন থাকে? কারাগার মানেই তো কষ্ট।
খাবারের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খাবারের মান খুব খারাপ। সকালে রুটি আর একটু গুড় দেয়। আর ভাতের সাথে যে সবজি দেয় তা খেতে পারে না। তবে আমার স্বামী টাকা দিয়ে কিনে খায়। এ পর্যন্ত দুইবার স্বামীর সাথে দেখা করেছি জানিয়ে তিনি বলেন, ও যখন এসেছে তখন সিট ভাড়ার জন্য পিসির মাধ্যমে আমি দুই হাজার দিয়েছিলাম। এরপর আর এখনো টাকা লাগেনি। এখন জামিনের চেষ্টা করতাছি বলেই বাসে উঠে চলে যান তিনি। দেখা গেল, প্রতিদিন গড়ে ৩ শ’ থেকে ৪ শ’ বন্দীর সাথে স্বজনেরা দেখা করছেন। তবে ১ শ’ টাকার স্লিপেই বেশি সাক্ষাৎ হচ্ছে বলে জানান বন্দীর স্বজনেরা।

সম্প্রতি এই কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সিঙ্গারবিল কাশিনগর এলাকার আব্দুর রহিমের ছেলে হুমায়ুন, সরাইল থানার চানমনিপাড়ার শুক্কুর আলীর ছেলে হাজতি কাজল ও বিজয়নগর ছতুরপুর এলাকার হাজতি কাদির। গত শুক্রবার কাদির এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি মাত্র এক দিন ছিলাম। তাই কারাগারের ভেতরের সঠিক তথ্য আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
তবে একটি দুর্ঘটনা মামলায় সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া হাজতি বন্দী এ প্রতিবেদকের কাছে নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, আমি এক সপ্তাহ ওই কারাগারে ছিলাম। দেখেছি টাকা দিলেই যেকোনো জিনিস মেলে। থাকতে হলে টাকা লাগে। জামিনে বের হতে গেলে গেটে ১ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা করে লাগে। না দিলেই ভয় দেখায়। খাবারের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি যে খাবার দেয়া হয় যেমন- ভাত, সবজি, ডাল সেগুলো না পারতে বন্দীরা খাচ্ছে। তবে বেশির ভাগ খাবার কারা ক্যান্টিন থেকে কিনে খাচ্ছে। তিনি কারাগারে এ সময়ের মধ্যে কোনো বন্দী নির্যাতনের ঘটনা দেখেননি বলে জানান।

ফ্রি স্টাইলে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রসঙ্গে জানতে গতকাল শনিবার ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ নুর উন নবী নয়া দিগন্তকে বলেন, এখানে কোনো টাকা খাওয়ার সুযোগ নেই কারো। বন্দীর স্বজনদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় ১ শ’-৫ শ’ টাকা দেয় সেটি দিয়ে বন্দীর স্বজনদের বসার জন্য ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া মসজিদের রাস্তা নির্মাণ করার কাজেও আমরা এই টাকা ব্যয় করছি। কারণ সরকারিভাবে একটি টাকাও আমাদের বরাদ্দ দেয়া হয় না। এ ছাড়া ভেতরে কেইস টেবিল বড় করা হচ্ছে।
সম্প্রতি কারাগারে একজন বন্দী মারা যাওয়া প্রসঙ্গে জেল সুপার বলেন, শফিকুর নামে যে বন্দী মারা গেছে তাকে নাকি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাই টেনশনে সে মারা গেছে। তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই কারাগারে বর্তমানে মাদক মামলার আসামি বেশি হলেও আমরা ৯৯ ভাগই মাদকমুক্ত রেখেছি।

No comments