Breaking News

৩৯ বছরের বিএনপি কতটা পরিপক্ব?

দলের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে দলের আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি না থাকলেও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও সেই কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনাও হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপির কর্মসূচি না নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে—ঈদুল আজহা। ঈদের পর কর্মসূচি নেওয়া হবে বলে দলের কোনো কোনো নেতা জানিয়েছেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মসূচি না নেওয়ার আসল কারণ খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি। তিনি মাস দেড়েক আগে চিকিৎসা ও জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করতে লন্ডন যান। ফিরবেন ঈদের পর। এ কারণেই প্রায় নীরবে চলে গেল বিএনপির ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। অন্যান্যবার বড় ধরনের কর্মসূচি না থাকলেও বিএনপির নেতারা দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিতে যেতেন। এবারও দিয়েছেন। তবে দলের প্রধান ছিলেন না।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তার আগে বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে করেছিলেন জাগো দল। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির হাল ধরেন তাঁরই সহধর্মিণী খালেদা জিয়া।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিএনপির নেত্রী এক বাণীতে বলেন, ‘আজ দেশে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে। ৫ জানুয়ারির তামাশার নির্বাচনের পর গণতন্ত্র এখন মৃতপ্রায়। দেশবিরোধী নানা চুক্তি ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমান সরকার জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পথেঘাটে শুধু লাশের মিছিল। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি নিয়ে হাহাকার চারদিকে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। দেশজুড়ে গণহত্যা, গুম, গুপ্তহত্যা, নারী ও শিশুদের ওপর পৈশাচিকতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মহোৎসব চলছে। শুধু তা-ই নয়, ঈদুল আজহার প্রাক্কালে একের পর এক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ গুম হওয়ায় চারদিকে ভয় ও আতঙ্ক পরিব্যাপ্ত হয়েছে। দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজমান।’
কিন্তু এই ‘শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি’ মোকাবিলায় বিএনপির কোনো কর্মসূচি বা পরিকল্পনার কথা জানা যায় না। অতীতে দেখা যেত, ১৫-২০ দিন আগে থেকে বিএনপি তৎপরতা চালাচ্ছে। জনসভার জায়গার জন্য দরখাস্ত করে নেতারা ডিএমপি অফিসে দৌড়ঝাঁপ করতেন। ঈদের পর কর্মসূচি হলেও আগে সময় চাইতে পারতেন। দলের কেউ কেউ বলছেন, সে রকম অবস্থায় খালেদা জিয়া দেশে ফেরার আগে সরকার সময় দিলে বিএনপি বিপদে পড়বে। দীর্ঘদিন পর দলটি চেয়ারপারসনকে ছাড়া জনসভা করার কথা ভাবতে পারে না।
দলটি কোন পথে যাবে—আন্দোলন না নির্বাচন? কিছুদিন আগেও দলের নেতাদের কথাবার্তায় নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। মনে হচ্ছে, ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে উচ্চ আদালতের সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে তাঁরা অবস্থান কিছুটা বদলেছেন। বিএনপি ইতিমধ্যে ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছে। বিএনপির নেতারা নিশ্চয়ই মনে করেন, তাঁদের ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ হলো নির্বাচন। তাঁরা সহায়ক সরকারের দাবি পূরণ করেই নির্বাচনে যেতে চান। যদিও সহায়ক সরকারের রূপরেখা তাঁরা দেননি।
সংবিধানে যে নির্বাচনের কথা আছে, সেটি নিশ্চয়ই নিয়ম রক্ষার নির্বাচন নয়। স্বাধীনভাবে পছন্দসই প্রতিনিধি বাছাই করার নির্বাচন। আগামী নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলে যেমন অস্থিরতা আছে, তেমনি বিএনপির মধ্যেও নানা বিভ্রান্তি রয়েছে। খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, সরকার আরেকটি তামাশার নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, তাঁর ভাষায় ‘সেই তামাশার’ নির্বাচন কীভাবে তিনি মোকাবিলা করবেন? একটি উপায় ২০১৪-এর মতো নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করা। আরেকটি হলো নির্বাচনে জনগণকে ভোটের অতন্দ্র প্রহরী করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সেই তামাশা ঠেকানো। পৃথিবীর দেশে দেশে বহু নজির আছে।
বিএনপির একাংশ মনে করে, নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশ নিশ্চিত হলে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়া উচিত। কেননা জনগণ বিএনপির পক্ষে আছে। আর নির্বাচনে না গেলে আওয়ামী লীগ এবারও ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন ও ঠেকানোর চেষ্টা করে বিএনপি লাভবান হয়নি।
তবে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও অনেকগুলো ধাপ আছে। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করলেও এই মুহূর্তে শেষ কথা জানাতে চায় না। ছয় সিটি করপোরেশনের ফলাফল দেখে নিতে চায়। ওই ছয়টি সিটি করপোরেশনের ২০১৩ সালে পাঁচটিতেই বিএনপির সমর্থক প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন।
বিএনপির বয়স ৩৯ বছর। আর ১ বছর পরই ৪০ বছর পূরণ হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের পরিপক্বতার জন্য এটি কম সময় নয়। এই ৩৯ বছরের মধ্যে বিএনপি ক্ষমতার বাইরেই বেশি সময় ছিল। তৃতীয় বিশ্বে যেকোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকতেই জনগণের বেশি কাছাকাছি আসে। এরশাদের সামরিক শাসনের সময় এবং শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে বিএনপি সেটি প্রমাণ করেছিল। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে পেরেছিল।
কিন্তু গত সাড়ে আট বছরে বিএনপি সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। এর সবটা দায় সরকারের চণ্ডনীতির ওপর চাপালে হবে না। বাংলাদেশে কোনো সরকারই বিরোধী দলের সঙ্গে ‘মধুর সম্পর্ক’ গড়ে তোলে না। তারপরও বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে হয়। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন কেন সফল হলো না?
তাহলে কি দলের নীতি ও পরিকল্পনায় কোনো ভুল ছিল?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক

No comments