Breaking News

সোনালি দিনের নায়িকাদের গল্প


সোনালী দিনের নায়িকারা সোনালী দিনের নায়িকারা
বাংলা চলচ্চিত্রের সেই সোনালি যুগের নায়িকাদের অনেকেই আজ স্মৃতি। এদের সবাই দর্শকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাই করে নিয়েছিলেন। কেউবা হয়েছেন গত , কেউবা বেঁচে থাকলেও পর্দায় নেই । অনেকে হয়েছেন কিংবদন্তী আবার অনেকে এক ঝলক আলো ছড়িয়ে হারিয়ে গেছেন ।

শবনম
হিন্দু ধর্মালম্বীর মেয়ে নন্দিতা বসাক ঝর্না শিশু শিল্পী হিসেবে ‘আসিয়া’ ছবিতে অভিনয় করেন । পরে শবনম নামে নায়িকা হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে। ১৯৬১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র হারানো দিনের মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন শবনম।
১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র চান্দা ছবির মাধ্যমে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পান। এ দু'টি ছবিই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
পরবর্তী বছরে তালাশ সমগ্র পাকিস্তানে মুক্তি পেলে ঐ সময়ের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল ছবির মর্যাদা লাভ করে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শবনম পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন।
তিনি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের করাচীতে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন। সত্তর দশকের শুরুতে শবনম ললিউডে (লাহোর) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন। তিনি নায়িকা হিসেবে পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে ধ্বস নামার পূর্বে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন।
কবরী
বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে কবরী চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে মাত্র ১৪ বছর বয়সে । চলচ্চিত্রে আসার আগে চট্টগ্রামের এই মিষ্টি মেয়ের আসল নাম ছিল মিনা পাল। বাংলা ছবির সোনালী সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এই নায়িকা প্রয়াত অভিনেতা ও পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ছবিতে ‘নবীতুন’ চরিত্রে অভিনয় করে অর্জন করেছিলেন সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
শাবানা
বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী শাবানা। সাবলীল অভিনয়ের কারণে অতি অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। দর্শক পর্দায় খাটিঁ বাঙ্গালী রমণীর ছায়া খুঁজে পায় অভিনেত্রী শাবানার অভিনয়ের মধ্যে।
শাবানা নায়িকা চরিত্রে যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ঠিক তেমন মা বা ভাবীর চরিত্রে অভিনয় করে সমান দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে চকোরী চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে আগমন ঘটে শাবানার।
শাবানা প্রথম জীবনে উর্দু ছবিই বেশি করতেন। তবে তিনি ১৯৬২ সালে ‘নতুন সুর’ ছবিতে প্রথম ছোট্ট মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন এবং ১৯৬৩ সালে তিনি উর্দু ‘তালাশ’ ছবিতে নাচের দৃশ্যে অংশ নেন।
এরপর তারপর বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি এক্সট্রা হিসেবে কাজ করেন।শাবানার প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এস এস প্রোডাকশন।শহর বা গ্রামীণ তরুণী, বধূ, মাতা এবং ভাবীর চরিত্রে দক্ষতার সাথে অভিনয় করে গেছেন শাবানা।
১৯৯৭ সালে শাবানা হঠাৎ করেই চলচ্চিত্র-অঙ্গন থেকে বিদায় নেওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর তিনি আর নতুন কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি।
ববিতা
ষাটের দশকের শেষ দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে যশোরের ফরিদা আখতার পপি নামের এক কিশোরীর যার চলচ্চিত্রে নাম রাখা হয় ‘ববিতা’ । স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সর্বপ্রথম পুরস্কার লাভ করার গৌরব অর্জন করেন
ষাটের দশকের শেষ দিকে (১৯৬৮) পরিচালক জহির রায়হান এর ‘জ্বলতে সুরুজ কি নীচে’ ছবির মাধ্যমে ববিতার চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু হয় । পরিচালক জহির রায়হান ছিলেন ববিতার আপন বড় বোন সুচন্দার স্বামী। সেই দুলাভাই জহির রায়হান এর হাত ধরে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটলেও প্রথম ছবি ‘জ্বলতে সুরুজ কি নীচে’ পরিচালক জহির রায়হান শেষ করতে পারেননি ।
এরপর নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত (১৯৬৯) ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে ফারুকের বিপরীতে অভিনয় করেন যা ছিল নায়ক ফারুকের প্রথম অভিনীত ছবি। এই ছবিটিও শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি । এরপর আবারো জহির রায়হান এর ‘সংসার’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ পান । সেই সুত্রে ববিতার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘সংসার’ ।
১৯৬৯ সালে তিনি নুরুল হক বাচ্চুর পরিচালিত ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে প্রথম নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই ছবিতেই তিনি সুবর্ণা নাম বদলে ‘ববিতা’ নাম দিয়ে অভিনয় শুরু করেন । এভাবেই একজন যশোর থেকে আসা ঢাকা গেণ্ডারিয়ায় পরিবারের সাথে বসবাস করা সেই অতি সাধারন কিশোরী পপি হয়ে উঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেত্রী ‘ববিতা’। সেই শুরু বাংলা চলচ্চিত্রে একজন ববিতার পথ চলা দর্শকদের মন জয় করে ।
নূতন
নূতনের চলচ্চিত্র জগতে আগমন ঘটে ১৯৭০ সালে মুস্তফা মেহমুদ পরিচালিত ‘নতুন প্রভাত’ সিনেমার মাধ্যমে।তারপর অল্প কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি চলচ্চিত্রে জগত থেকে সাময়িক বিদায় নেন। ১৯৭৮ সালে অভিনেতা রুহুল আমিন বাবুলকে বিয়ে করে আবার চলচ্চিত্র জগতে ফিরে আসেন।
নূতন তাঁর ২৮ বছরের তারকা জীবনে প্রায় ২০০-এর কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেছেন।অধিকাংশ ছবিতে তিনি ছিলেন সহ নায়িকা।
সুচরিতা
টিনএজ ইমেজ নিয়ে রুপালী পর্দায় হাজির হয়েছিলেন একটি মিষ্টি মেয়ে যার নাম সুচরিতা । সুচরিতা একজন শিশু শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন যখন তাঁর নাম ছিল বেবী হেলেন।
১৯৬৯ সালে শিশু শিল্পী হিসেবে বাবুল ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। ‘বাবলু’ চলচ্চিত্রে তিনি শিশু শিল্পী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। নায়িকা হিসেবে সুচরিতা নায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৭২ সালে পরিচালক আজিজুর রহমানের মাধ্যমে।
প্রথমদিকে তিনি খুব একটা সফল না হলেও পরে ভালোই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং প্রথম শ্রেণীর নায়িকা হিসেবে জায়গা করে নেন। ১৯৭৭ সালে আবদুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত ‘যাদুর বাঁশী’ ছবিটি তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে দেয়। ক্যারিয়ারের এক জনপ্রিয় মূহুর্তে তিনি বিয়ে করেন চিত্র নায়ক জসিমকে তবে এই সংসার বেশী দিন টেকেনি এবং তিনি আবার চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি বেশ কিছু বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির পুরস্কার লাভ করেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে।
অঞ্জু ঘোষ
৮০র দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের ফোক ফ্যান্টাসি ছবির জনপ্রিয় নায়িকা অঞ্জু ঘোষের আগমন ঘটে। চলচ্চিত্রে আগমনের আগে তিনি চট্টগ্রামের মঞ্চে বাণিজ্যিক নাটকের অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর আসল নাম অঞ্জলী ঘোষ।
১৯৮২ সালে এফ, কবীর চৌধুরী পরিচালিত ‘সওদাগর’ সিনেমার মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে।এই ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফল ছিল। দর্শক অবাক বিস্ময়ে তাঁর অশালীন অঙ্গভঙ্গি এবং উম্মাতাল নৃত্য উপভোগ করেন। তিনি বাংলার নীলো নামে পরিচিত ছিলেন।তিনি রাতারাতি তারকা বনে যান।অনেকের মতে অঞ্জুর সাফল্য ছিল ভিত্তিহীন মৌলিক সাফল্য।অঞ্জু বাণিজ্যিক ছবির তারকা হিসেবে যতটা সফল ছিলেন সামাজিক ছবিতে ততটাই ব্যর্থ হন।
১৯৮৬ সালে তাঁর ক্যারিয়ার বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও তিনি ফিরে আসেন ভালোভাবে।১৯৮৭ সালে অঞ্জু সর্বাধিক ১৪টি সিনেমাতে অভিনয় করেন মন্দার সময়ে যেগুলো ছিল সফল ছবি।তাঁর অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ অবিশ্বাস্য রকমের ব্যবসা করে এবং সৃষ্টি করে নতুন রেকর্ড।তিনি সুঅভিনেত্রীও ছিলেন। ১৯৯১ সালে বাংলা চলচ্চিত্রে নতুনের আগমনে শাবনাজদের মতো নায়িকাদের দাপটে তিনি ব্যর্থ হতে থাকেন। তিনি এই দেশ ছেড়ে চলে যান এবং কলকাতার চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকেন। বর্তমানে তিনি ভারতে বিশ্বভারতী অপেরায় যাত্রাপালায় অভিনয় করছেন।
রোজিনা
রোজিনা চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৭৬ সালে ‘জানোয়ার’ ছবির মাধ্যমে। এর আগে তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রনকারী পণ্য ‘মায়া বড়ি’র বিজ্ঞাপনে মডেল হয়ে সবার নজরে আসেন । পরে তিনি এফ, কবীর পরিচালিত ‘রাজমহল’ সিনেমার মাধ্যমে একক নায়িকা হিসেবে কাজের সুযোগ পান।এই ছবিটি সফল হয় এবং তিনি হাতে বেশ কিছু ছবি পান। রোজিনার বেশির ভাগ ছবিই পোষাকী। সুঅভিনয় ও গ্ল্যামার দিয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীর নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৮০ সালে রোজিনা ‘কসাই’ ছবির জন্য জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি জাতীয় পুরস্কার পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর হিসেবে ‘জীবন ধারা’ ছবির জন্য।শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে তিনি বাচসাস পুরষ্কারও লাভ করেন ।
চম্পা
চিত্রনায়িকা সুচন্দা ও ববিতার বোন চম্পা । তিনি প্রথমে মডেলিং-এর মাধ্যমে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন।তারপর টিভি নাটকে অভিনয় করতে থাকেন এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘তিনকন্যা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চম্পা চলচ্চিত্রের জগতে আগমন করেন।
চম্পার অভিনয় দক্ষতা ও ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য তাঁকে চলচ্চিত্রে সাফল্য এনে দেয়।সামাজিক ও অ্যাকশন উভয় প্রকার সিনেমাতে তিনি অভিনয় করেছেন। কোন নির্দিষ্ট গন্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি সত্যজিত রায়ের ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের ‘টার্গেট’ সিনেমাতে এবং বুদ্ধদেব দাশ গুপ্তের ‘লালদরজা’ সিনেমাতে অভিনয় করার সুযোগ পান।এভাবে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। ১২ বছরের ক্যারিয়ারে প্রায় ১০০-এর বেশি সিনেমাতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। বর্তমানে তিনি পর্দায় অনুপস্থিত। ৮০র দশকের শেষ দিক থেকে ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চম্পা দুর্দান্তভাবে একের পর এক ছবি উপহার দিয়ে গেছেন । 

No comments