ধর্ষণের ফাঁদ হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার করছে ।
মুঠোফোনে কিশোরী ও তরুণীদের সঙ্গে খুব দ্রুত প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে তারা পাতছে ধর্ষণের ফাঁদ। আর এ জন্য তারা ব্যবহার করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। ধর্ষণের শিকার তরুণীদের সঙ্গে ফেসবুকে খুদে বার্তা (এসএমএস) আদান-প্রদান করে ও ভিডিওকল করে দুর্বৃত্তরা স্বল্প সময়ের মধ্যে মেয়েদের সরাসরি দেখা করার জন্য রাজি করাচ্ছে। তবে যৌন নির্যাতন করার সময় কেউ একটু সময় নিয়ে, আবার কেউ প্রথম সাক্ষাতেই অপরাধ করছে। এমনকি নির্যাতনের এ দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করে কখনো ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার করছে বা পরে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ আবার তা ইউটিউবেও ছেড়ে দিচ্ছে। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, ইউটিউবে এখন এসব যৌন নির্যাতনের অনেক ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে। কেউ আবার ভিডিওটি পছন্দ হলে ‘লাইক’ ও ‘শেয়ার’ দেওয়ার কথা বলে নির্বিচারে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মোবাইল-ফেসবুকের মাধ্যমে যৌন নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশও (ডিএমপি)। বিশেষজ্ঞদের মতে, যৌন নির্যাতনের এসব ভিডিও এখনই বন্ধ করা না গেলে পরে তা সমাজে মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব কম সময়ের মধ্যে এবং অর্থ খরচ না করেই ফেসবুকের মেসেঞ্জারের মাধ্যমে দুর্বৃত্তরা কিশোরী- তরুণীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের প্রেমের ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। একই কাজ মোবাইলের মাধ্যমেও করা হচ্ছে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হতাশাগ্রস্ত ও বেকার যুবকরা এই অপরাধ করছে। এ ক্ষেত্রে ঘটনাটি বেশি স্পর্শকাতর হলেই মামলা করা হয়। না হলে অপরাধীকে ডেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। এরপর সেই মেয়েটিকে পুনরায় হয়রানি করছে কি না দেখা হয়। উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের প্রধান ডিএমপির ডেপুটি কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের অনেক ঘটনাই আসছে। তবে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা থাকায় আমাদের কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে মামলা আসছে তা সাইবার ক্রাইম ইউনিটে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ’ তিনি মনে করেন, ফেসবুক ও মুঠোফোনের অপব্যবহারের কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো অপরাধ দিন দিন মহামারী রূপ নিচ্ছে। রাজধানীর বনানী এলাকায় কিছুদিন আগেই এক ব্যবসায়ীর ছেলে জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে এক তরুণীকে বাসায় ডেকে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণী বনানী থানায় ধর্ষণের মামলা করেন। ফেসবুকে ১১ মাসের পরিচয়ে তরুণীটির সঙ্গে অভিযুক্তের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর মিথ্যার জালে ফেলে ওই তরুণীকে বাসায় ডেকে সেই ব্যবসায়ীপুত্র তার ওপর নির্যাতন চালায়। পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে তরুণী জানান, এর আগেও তাকে সেই তরুণ জোরপূর্বক নির্যাতন চালিয়েছিল এবং কাউকে এ কথা জানালে তার ধারণ করা আপত্তিকর ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। রাজধানীর চাকরিপ্রত্যাশী এক তরুণীর সঙ্গে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর বামনগর ডিগ্রি কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক শামসুল আলম বাদশার ঘটনাটিও প্রায় এক। ফেসবুক থেকে পরিচয়। অতঃপর কথার আদান-প্রদানে একসময় তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। এরপর আগস্টের শুরুতে প্রথম দেখায় রাজশাহীর একটি গেস্টহাউসে সেই শিক্ষক তার বন্ধু আবু ফয়েজকে নিয়ে মেয়েটির ওপর নির্যাতন চালান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী মেয়েটি শাহ মাখদুম থানায় বাদশা ও তার বন্ধুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। ফেসবুকে প্রতারণা করে সম্পর্ক গড়ে তুলে এক তরুণীর ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হন রাজধানীর ড্যানি নামের আরেক তরুণ। ফেসবুকের মেসেঞ্জারের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ড্যানি বেশ কয়েকবার ভুক্তভোগী সেই তরুণীকে ধর্ষণ করে। পরে ছেলেটির মিথ্যাচারের কথা জানতে পেরে মেয়েটি সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সঙ্গে দেখা করতে অসম্মতি জানান। এতে আগে থেকে ভিডিওতে ধারণ করা মেয়েটির আপত্তিকর চিত্র ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় ড্যানি। এমনকি সেই ছবি দেখিয়ে মেয়েটির কাছ থেকে বেশ কয়েকবার টাকাও আদায় করে। এরপর মেয়েটির অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখা সেই যুবককে গাইবান্ধা থেকে গ্রেফতার করে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার বান্দাবাড়ী গ্রামের এক তরুণীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের জুয়েল নামের এক যুবকের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ৬ আগস্ট তরুণীটি তার ছোট বোনকে নিয়ে সেই যুবকের সঙ্গে দেখা করার জন্য কোটালীপাড়া থেকে ঈশ্বরগঞ্জ আসেন।
এরপর জুয়েল মেয়েটিকে বিয়ের কথা বলে রাজীবপুর নিয়ে যায়। সেখানে রাজীবপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি বোরহানউদ্দিনসহ কয়েকজন মিলে মেয়েটির স্বর্ণালঙ্কার ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে লাঠিয়ামারী বাজার-সংলগ্ন বেড়িবাঁধে নিয়ে ধর্ষণ করে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুঠোফোন ও ফেসবুকে অল্প পরিচয়ে কিশোরী-তরুণীদের কারও সঙ্গে একা দেখা করতে যাওয়া উচিত নয়। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসেছে।
No comments