রাজনীতির নীল তিমি খেলা বড়ই ভয়ঙ্কর
নঈম নিজাম
দাপুটে এই নেতা ৯১ সালে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। আমাদের বন্ধুত্বও তখন থেকেই। ৯১ এবং ৯৬ সালে স্বাভাবিকভাবে জয়ী হন। কিন্তু ২০০১ সালে দল ক্ষমতা ছাড়ার পরই তাকে চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঝড় শুরুর এক রাতে তাকে আটকও করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে জামালপুরের মানুষ বেরিয়ে আসেন ঘর ছেড়ে। তারা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। জনতা আগুন ধরিয়ে দেয় জামালপুর রেলস্টেশন, জেলা প্রশাসনসহ সব সরকারি অফিস, আদালতে। শুধু জামালপুর সদর নয়, সব উপজেলাতেও আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সরকার তাকে আটকে রাখতে পারল না। আটকের কয়েক ঘণ্টা পর বিক্ষুব্ধ মানুষকে শান্ত করতে মধ্যরাতে আদালত বসিয়ে জামিন দেওয়া হয় মির্জা আজমকে। আজমের ঘটনা শুধু নয়, সারা দেশ থেকে খবর আসতে থাকে নেতিবাচক। বুঝতে পারছিলাম আওয়ামী লীগ ভোটে খারাপ করবে। কিন্তু আমার একটা কনফিডেন্স ছিল সারা দেশে অল্প কিছু মানুষ ভালো করলে তার মাঝে মির্জা আজম থাকবেন। ফোনে মির্জা আজম বার বার বলছিলেন, তার অবস্থা ভালো নয়। তিনি খারাপ করবেন। কারণ মানুষ ভোট দিতে যেতে পারবে কিনা তার সংশয় রয়েছে। এ কারণে তিনি চান তার এলাকায় যাতে নিরপেক্ষ ভোট হয়। মানুষ যাতে কেন্দ্রে যেতে পারে। মানুষের কেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ নিয়ে আমার মাঝে আগেই সংশয় তৈরি হয়েছিল। আমার প্রিয় নাঙ্গলকোটে তখন আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর শুরু হয়ে গিয়েছিল। এলাকায় গিয়ে দেখে এসেছিলাম ভয়ঙ্কর পরিবেশ। দুই দিন আগে যে ওসি, এসআই আওয়ামী লীগকে সালাম দিত, তারা হঠাৎ বদলে গেছেন। বিএনপিকে সহায়তা করছেন ভাঙচুরে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাড়িতে হামলায়, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি পুড়িয়ে দিতে। বিদায়ী সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়ার সঙ্গে বার বার কথা হচ্ছে। একদিন তার ওপরও হামলা হলো আমার পাশের চাটিতলা গ্রামে। অবাক হলাম। তিনি বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। টাকার কাছে প্রশাসন বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ভোট করে লাভ হবে কি? আমি বললাম, মানুষ কেন্দ্রে যেতে পারলে আপনি জিতবেন। নাঙ্গলকোটে দলমত নির্বিশেষ আপনার একটা সমর্থন আছে। পাঁচ বছর আপনি আর আমি মিলে উন্নয়ন তো কম করিনি। তবুও জয়নাল ভাই আশ্বস্ত হতে পারেন না। চাটিতলা গ্রামের হামলা আতঙ্ক তৈরি করে। সংশয় ভোট নিয়ে নয়। ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে। বুঝতে পারি অবস্থা ৯৬ এবং ৯১ সাল থেকে আলাদা।
এই গল্পগুলো অন্য কারণে বলা। দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে পুরনো দিনের কিছু বিষয় আমার মাঝে মাঝে মনে হয়। বয়স বাড়ছে। তাই নস্টালজিক হচ্ছি। ভোট আসলে এক কঠিন পরীক্ষা। এই ভোটের পরিবেশে প্রশাসন কখন কোনদিকে অবস্থান নেবে কেউ বলতে পারে না। আজ ক্ষমতায় আছে বলে তার দিকে প্রশাসন থাকবে এমন গ্যারান্টি নেই। ২০০১ সালের চিত্র ভুলে গেলে হবে না। ২০১৪ সালেও কিছু কিছু দেখেছি। ২০০৭ সালের ১/১১ এর পর বিএনপি কিছুটা টের পেয়েছিল। ভোটের হিসাব-নিকাশ এ কারণেই আগাম মেলানো ঠিক নয়। ঢাকা সিটি নির্বাচনে তাবিথ আউয়াল আর চট্টগ্রামে মনজুর আলম বেলা ১১টায় প্রত্যাহার করে নিলেন। কিন্তু রাতে তাদের বাক্সে ভোটের পরিমাণ দেখে শুধু তারা নন, দেশবাসীও চমকে উঠেছিল। সর্বশেষ কুমিল্লাতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কী নির্দেশ ছিল জানি না। কিন্তু প্রশাসন বিএনপি প্রার্থী সাক্কুকে সহায়তা করেছে। এই পক্ষপাত নিরপেক্ষতা নয়। নিরপেক্ষ থাকা আর পক্ষপাত করার মাঝে পার্থক্য আছে। যেমন ছিল ৯১ সালে। সেই সময় প্রশাসন অনেকটা নিরপেক্ষ ছিল। ভাবখানা যে খুশি হোক। আজকের কাগজে কাজ করি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিটে কাজ করতাম। পত্রিকার ব্যস্ততায়ও জয়নাল ভাইর জন্য নাঙ্গলকোট যেতে হতো। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বিএনপির প্রার্থী ডা. কামরুজ্জামান। কিন্তু মাঠে তার পক্ষে কোনো কর্মী দেখিনি। কর্মীদের ঢল জয়নাল আবেদীনের পক্ষে। কামরুজ্জামান সাহেব প্রচারণায় যেতেন তার এক ভাতিজাকে নিয়ে। আওয়ামী লীগাররা হাসাহাসি করত। ভোটারদের মনোভাব বুঝতে পারছিলাম না। ভোট নিরপেক্ষই হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত জিতলেন কামরুজ্জামান।
দেশে এখন আওয়ামী লীগের জয়জয়কার। মনে হচ্ছে, কোথায়ও কোনো সমস্যা নেই। চারদিকে শুধুই আওয়ামী লীগ। বাস্তবে কী? প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে কিছু ঝামেলা ছিল, কেটে গেছে। বাস্তবতা কী? অতীত আমরা সহজে ভুলে যাই। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই সবাইকে সামনে যেতে হবে। তাহলে কোনো সমস্যা থাকে না। প্রধান বিচারপতির ঘটনার পর ফেসবুকে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের একটা স্ট্যাটাস আমার চোখে পড়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘বিগত কয়েক বছরে উচ্চপর্যায়ে আরও অনেক নিয়োগ এবং পদোন্নতি নিয়ে সরকারকে আগামীতে প্রধান বিচারপতির মতো বিব্রতকর এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বলে আমার মনে হয়। কারণ এসব নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে যারা ভূমিকা রাখছেন তাদের অধিকাংশই আমাদের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। আর পক্ষভুক্ত বলে যারা পরিচিত তারা রাজনৈতিক জ্ঞানবর্জিত। ’ নাসিমের এই বক্তব্য বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ ২০০১ সাল থেকে ক্ষমতায় আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে থেকে প্রশাসনিক কাঠিন্য দেখেছেন নাসিমরা। প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক উপসচিব ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এই নেতার বক্তব্য আগামীর জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জিং অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। জানি, কথায় আছে জয়ের কোনো ক্ষয় নেই, ক্ষয়ের জয় নেই। এখন জয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ। এমন জয়ে সব ক্ষমতাসীন দলই থাকে। কারণ ক্ষমতা যতক্ষণ আছে সবাই আপন থাকে। ক্ষমতা ছাড়লে, বিপদে পড়লে টের পাওয়া যায় কে কত আপন।
বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাদের আপন ভেবেছিলেন ওয়ান-ইলেভেনের আগে ও পরে তারাই তার সর্বনাশ করেছেন। এরশাদের আপনজনরা এক পলকে তার থেকে সরে গিয়েছিলেন। রাজনীতির সর্বনাশা খেলা বড়ই ভয়ঙ্কর। এই নীল তিমির খেলায় গর্তে একবার পড়লে আর ফেরা যায় না সহজে। তখন অঙ্কের সাপ লুডু খেলায় বার বার ওঠানামা করতে হয়। এ কারণে রাজনীতিতে ভেবে কাজ করা ভালো। সব কিছু সামলে চললে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু সব ঠিক আছে এই অহমিকা ভর করলেই সর্বনাশ হয়ে যায়।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
Post Comment
No comments