এবার হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস
শাইখ সিরাজ
নানা কারণে উন্নত বিশ্ব এখন আর মাঠ কৃষিতে থাকছে না। কৃষিকে তারা হাতের মুঠোয় চুলচেরা হিসাবের মধ্যে আনার জন্যই শুরু করেছে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার। মাঠের কৃষিকে নিয়ে গেছে ঘরের ভিতর। গ্রিনহাউসের নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা, আলো ও অন্যান্য উপাদানের কৃত্রিম আয়োজন করে কৃষি আবাদ করে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছে তারা। একে একে ইউরোপ, আমেরিকার পথ ধরে মধ্যপ্রাচ্য এ ব্যাপারে অনেক বেশি উদ্যোগী। কারণ কৃষি উৎপাদনের জন্য তাদের অনুকূল মাটি, পানি ও জলবায়ু নেই। গ্রিনহাউসে মাটি ছাড়াই হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ফল ও সবজি উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে তারা। বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে বড় বড় উদ্যোক্তা গড়ে তুলছেন অত্যাধুনিক বাণিজ্যিক কৃষি খামার। আমি গত এক দশক এই গ্রিনহাউস কৃষির ক্রমবিকাশ খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করছি। প্রযুক্তিগুলো খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। বড় বড় বিনিয়োগকারী এই গ্রিনহাউস কৃষিতে আগ্রহী হচ্ছেন। করপোরেট পরিবেশে কৃষিকাজ করার এই বাণিজ্যিক উদ্যোগে তারা আকৃষ্ট হচ্ছেন। আমি এর আগেও এ বিষয় নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করেছি। কৃষি উৎপাদনে পৃথিবীর দেশে দেশে এই বিকাশমান প্রযুক্তিনির্ভর গ্রিনহাউস প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও একাধিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছে গ্রিনহাউস। এবার নতুন চমক এনে হাজির করল ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি। চমক এজন্য যে, সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হাউড্রোপনিক ঘাস উৎপাদনের সফল কার্যক্রম তারা চালিয়ে যাচ্ছে। মজবুত ও ধাতব স্থায়ী কক্ষে হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদনব্যবস্থাটি একটি পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজের মতো। গরুর কাঁচা ঘাস উৎপাদন করে নিয়মিত জোগান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা। গরুর সংখ্যা বেশি হলে আয়োজনটি বড় করতে হবে। সংখ্যা কম হলে আয়োজনটি ছোট হবে। একটি বড় কক্ষের মধ্যে পৃথক সাতটি ক্ষেত্র। যেখানে বীজ থেকে গরুর খাদ্যোপযোগী পূর্ণাঙ্গ ঘাস উৎপাদন হতে সময় লাগছে সাত দিন। সাত দিনের আবর্তনে বীজ থেকে এই ঘাস উৎপাদন প্রক্রিয়াটি বছরব্যাপী চালু রেখে নিয়মিত কাঁচা ঘাস পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশে যারা গরু লালন-পালন করেন, গরু মোটাতাজা, দুধের জন্য গাভী পালেন, তারা জানেন ঘাসের চাহিদা কেমন। কাঁচা ঘাসের অভাবে দুধ উৎপাদন কমে যায়, মাংসের পরিমাণও কম হচ্ছে। অন্যদিকে জমি কমে আসছে। যদিও এখনো অনেক খামারি নেপিয়ারসহ উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাতের ঘাস উৎপাদন করেন। জমির অভাবে ঘাস উৎপাদনও এখন প্রতিকূল হয়ে উঠেছে। এসব প্রতিবন্ধকতার কথা চিন্তা করে অল্প পরিসরে অনেক বেশি পরিমাণ ঘাস উৎপাদনের জন্য এই প্রকল্প। বিসিএসআইআরের প্রকল্পটির নাম সেন্টার ফর টেকনোলজি ট্রান্সফার অ্যান্ড ইনোভেশন। প্রকল্পের পরিচালক রেজাউল করীম। তিনি বলছেন, হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত ঘাসে রয়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রোটিন। গম বা বার্লির বীজ থেকে এই ঘাস উৎপাদন করা যায়; যা গরু-বাছুরকে খাওয়ালে মাংসের উৎপাদন বাড়ে, বাড়ে দুধের পরিমাণও। যারা বাণিজ্যিকভাবে গরু-বাছুর পালছেন বা যারা বাণিজ্যিকভাবে ঘাস উৎপাদন করতে চাচ্ছেন তাদের জন্য এটি লাগসই প্রকল্প হতে পারে। প্রযুক্তিটি সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক। একটি বড় শিপিং কনটেইনারের এক পাশে নিচ থেকে ওপরের দিকে সারি সারি ট্রে সাজানো। এক টনের একটি এসি নিয়ন্ত্রণ করছে তাপমাত্রা। সূর্যের আলোর বিকল্প হিসেবে রয়েছে এলইডি লাইট। প্রথমে একটি পাত্রে বীজ দেওয়া হয়। বীজ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে গম বা গমের মতো শস্য। বীজ হাইড্রোজেন পার অক্সাইডে ভিজিয়ে রাখা হয় ছয় থেকে আট ঘণ্টা। এটি মূলত বীজকে জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানসম্মত এ কাজগুলো কঠিন কিছু নয়।
তারপর চেম্বারের ট্রেতে বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বীজের অঙ্কুরোদগম হয় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। দ্রুত অঙ্কুরিত বীজ থেকে চারা বড় হতে থাকে। বদ্ধ ঘরের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সবুজাভ হয়ে উঠতে থাকে গমের চারাগুলো। একেবারে বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান। প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করীম জানাচ্ছেন, এই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উৎপাদিত গো-খাদ্য বা ঘাসের পুষ্টিমান সাধারণ ঘাস বা যে কোনো খাবারের চেয়ে অনেক গুণে বেশি। বিসিএসআইআরের হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদন প্রকল্প স্থাপনে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে আমেরিকার ‘ফডারটেক’ নামের একটি কোম্পানি। তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি একজন কর্মকর্তাকেও পাঠিয়েছে হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য। তার নাম রাসেল অ্যামেসব্ল্যাক। তিনি বলছিলেন, দানাদার খাদ্যে যে পরিমাণ পুষ্টিমান থাকে তার চেয়েও ৫০ গুণ বেশি পুষ্টিমান থাকে সবুজ ঘাসে। এ প্রকল্পে পানির অপচয় নেই বললেই চলে। ব্যবহূত পানির ৯৮% আবার ব্যবহার করা হয়। সাধারণত একটি পাইপের মাধ্যমে পানির প্রবাহ সচল রাখা হয়। ব্যবহূত পানি পরিশোধিত হয়ে একটি ট্যাংকে জমা হয়। এই পানি বার বার ব্যবহার করা যায়। প্রশ্ন হলো, মোটামুটি ব্যয়বহুল এই ঘাস উৎপাদনব্যবস্থাটি কারা ব্যবহার করবে? গবেষক রেজাউল করীম জানাচ্ছেন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বড় খামারিরা এমন একটি প্রকল্প গড়ে তুললে তা থেকে বহুভাবে লাভবান হবেন। ৭ লাখ টাকা খরচে এই প্রযুক্তিতে ১০০ গরুর প্রতিদিনের ঘাস উৎপাদন সম্ভব। ছোট আকারে শুরু করতে খরচ হবে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। এসি ছাড়া বিদ্যুতে তেমন বেশি খরচ নেই। কিন্তু সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাই প্রয়োজন হতে পারে বিকল্প বিদ্যুৎ সংযুক্তির। ১ কেজি গম থেকে পাওয়া যায় ৬ থেকে ৯ কেজি ঘাস। বলে রাখা প্রয়োজন, এ ঘাস গবাদিপশুর দৈনিক খাবারের ৫০% চাহিদা মেটাবে। বাকি ৫০% দিতে হবে দানাদার খাবার। রেজাউল করীমের দাবি, গবেষণা করে দেখেছেন আড়াই কেজি ঘাস থেকে ১ লিটার দুধ মেলে এবং ৪ কেজি ঘাসে মেলে ১ কেজি মাংস। বিসিএসআইআরের চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদও বললেন, এই প্রযুক্তি মূলত শিল্পোদ্যোক্তারা নিতে পারেন। কিংবা আর্থিকভাবে যে খামারিরা সচ্ছল তাদের জন্য এটা বেশ লাভজনক। ইতিমধ্যে ঢাকা ও আশপাশ এলাকার খামারিরা এখান থেকে নিয়মিত ভিত্তিতে ঘাস সংগ্রহ করে গরুকে খাওয়াচ্ছেন। এতে উপকৃতও হচ্ছেন তারা। কৃষিভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থাই পাল্টে যাচ্ছে। এই পাল্টে যাওয়ার পেছনে যেমন রয়েছে আবাদি খেতের স্বল্পতা মোকাবিলা করা, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গাণিতিক হিসাবে ফসল উৎপাদন করা। ইতিমধ্যে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় গ্রিনহাউস কৃষির তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গবাদিপশুর পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের জন্যও এই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের কথা চিন্তা করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। কারণ দিনে দিনে নগরায়ণের প্রভাবে ক্রমে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে গোচারণভূমি ও প্রাকৃতিক ঘাসের উৎসগুলো। একই সঙ্গে গবাদিপশুর মাংস ও দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আমরা উচ্চমাত্রার আকাঙ্ক্ষা করছি। এসব দিক বিবেচনায় এই গ্রিনহাউসে পুষ্টিকর ঘাস উৎপাদন প্রযুক্তি একটি স্থায়ী ও কার্যকর অবকাঠামো হতে পারে। যারা বড় আকারে গরুর খামার গড়ে তুলেছেন, তারা বিসিএসআইআরের কারিগরি সহায়তা নিয়ে গড়ে তুলতে পারেন স্থায়ী এই অবকাঠামো। সেই সঙ্গে দেশের সাধারণ খামারিরা এই অবকাঠামো সামনে রেখে চিন্তাভাবনা করতে পারেন কীভাবে অবকাঠামো ব্যয় কমিয়ে এনে একই প্রক্রিয়ায় ঘাস উৎপাদন করা হয়। বিসিএসআইআরের উচিত হবে একেবারে কম খরচে কীভাবে কৃষকের বাড়িতে ও খামারে ঘাস উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারে কারিগরি সহায়তা দেওয়া। কৃষক-খামারিরা একটু সূত্র পেলেই সামান্য ব্যয়ে এমন ঘাস উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
No comments