Breaking News

আমাদের সিনেমা শিল্পের অবস্থা ভালো নয়।

কাজী হায়াৎ
কেমন আছে আমাদের সিনেমা শিল্প
আমাদের সিনেমা শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। পত্র-পত্রিকার লেখায়, সিনেমা শিল্পের মানুষদের মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারে প্রায়ই শোনা যায় এই একই কথা।

নতুন সিনেমা রিলিজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক সপ্তাহের মধ্যে পেনড্রাইভের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে দর্শকদের মুঠোফোনে। প্রযোজকদের হচ্ছে অনেক লোকসান। অথচ এর মধ্যেও বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে সিনেমার পাঠদান কর্মসূচি। অনেক মেধাবী যুবক ছেলে স্বউদ্যোগে সিনেমার বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে। তাহলে কি সত্যিই সিনেমা শিল্পে দুরবস্থা বিরাজমান? তাহলে ওই শিক্ষা গ্রহণ যারা করছে তারা কি ভুল করছে? এর মধ্যে সিনেমার বয়োজ্যেষ্ঠরা অনেক সময় হতাশ হয়ে বলেই ফেলছেন অচিরেই বাংলাদেশে সিনেমা শিল্প বলে কিছু থাকবে না। চলমান চিত্র থাকবে, চলচ্ছবি থাকবে, চলচ্চিত্র থাকবে কিন্তু সিনেমা থাকবে না। অর্থাৎ যে চলমান চিত্র প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয় তাকেই সিনেমা বলা হয় তা থাকবে না। কিন্তু এখানেও আবার একটি বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে অনেক সিনেপ্লেক্স। ইতিমধ্যে গত ঈদুল আজহায় দুটি সিনেপ্লেক্স উদ্বোধন করা হয়েছে। আরও কয়েকটি প্রায় নির্মাণের শেষ পর্যায়ে। আমাদের দেশের সিনেমায় যা কখনই ছিল না, তা হলো অনেক বড় বড় করপোরেট অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করছে অনেক সিনেমা নির্মাতা গোষ্ঠীকে। সিনেমা নির্মাণে আসছে  নতুন নতুন পুঁজি। তাহলে কি বলা যায় সিনেমার খুব দুর্দিন? তবে সিনেমার দুর্দিনের কথা এবং হাহাকার শোনা যায় শুধু কাকরাইলে গেলে, যেখান থেকে আমাদের অধিকাংশ সিনেমা বিপণন বা বাজারজাত করা হয়। সেখানে গেলে জানা যায়, সিনেমা রিলিজের এক সপ্তাহ পরে অনেক প্রযোজক অফিস বন্ধ করে বিদায় নিচ্ছেন চিরতরে। এদিকে শুধু প্রযোজক সমিতি বাদ দিয়ে অন্য অনেক সমগোত্রীয় সংগঠন চলছে বেশ দাপটের সঙ্গে। ঢাকঢোল পিটিয়ে অনেক অর্থ ব্যয় করে নির্বাচনের এক মাস আগে থেকে খাওয়া-দাওয়াসহ মহাসমারোহে চলছে সমিতিগুলোর নিয়মিত নির্বাচন। সমিতির সংঘবিধি লঙ্ঘনে অনেক সংগঠনে চলছে বহিষ্কারাদেশ, নিষেধাজ্ঞা, আন্দোলন হচ্ছে যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণার সিনেমার বিরুদ্ধে। এ সংগঠনগুলোকে আরও জোরদার করার জন্য ইতিমধ্যে সব সংগঠন মিলে গঠিত হয়েছে ‘চলচ্চিত্র পরিবার’ নামে আরও একটি সংগঠন।
সিনেমা শিল্পের নিয়মশৃঙ্খলা ও দীর্ঘদিনের অনিয়ম দূর করে দেওয়ার জন্য চলছে তাদের প্রাণান্ত চেষ্টা। এ চেষ্টার মধ্যে পড়ে অনেকে হচ্ছেন বহিষ্কার, হারাচ্ছেন সংগঠনের সদস্যপদ, আবার কেউ কেউ শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এসব কর্মকাণ্ডকে অনেকেই নিন্দা করছেন। তাই অনেক সময় সমাজের বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ দর্শকরাও হচ্ছেন এসব কর্মকাণ্ডের জন্য সমালোচনামুখর। তারা বলছেন যে সিনেমা শিল্পের মানুষগুলোকে আমরা এত সম্মান করি, বিশেষ করে সিনেমা শিল্পীদের আমরা কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় না এনে তাদের সমাজের বিবেক বলেই জানি। এহেন আচরণ আমরা কখনই তাদের থেকে আশা করি না। ডিজিটাল মিডিয়ায় এখন অনেক সামাজিক গণমাধ্যম আছে। মুহূর্তের মধ্যে অনেক ছোটখাটো ঘটনা ছবিসহ চলে আসছে সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বেশ কিছু দিন সিনেমা তৈরি করছি না। আমি এখন একজন পেশাদার অভিনেতা বললেই চলে। কিছু দিন আগে শামীম আহমেদ রনি নামে একজন পরিচালক ‘রংবাজ’ ছবির গল্প শুনিয়ে আমাকে তার সিনেমায় অভিনয় করার জন্য চুক্তিবদ্ধ করলেন। ওই সিনেমার শুটিং করতে চলে গেলাম পাবনা। শুটিং স্পটে দেখি পরিচালক উপস্থিত নেই। অন্য আর একজন পরিচালক নির্দেশনা দিচ্ছেন। আমি উপস্থিত সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম পরিচালকের ছবি করতে এলাম সে কোথায়? সেখানে উপস্থিত সবাই আমাকে বললেন, ‘আপনি জানেন না আঙ্কেল ওকে তো পরিচালক সমিতি বহিষ্কার করেছে। ওর সদস্যপদও বাতিল করেছে। ’ আমি বললাম, সদস্যপদ বাতিল করেছে কী কারণে তা আমি জানতে চাই না। সেটা তো সমিতির কাজ সমিতি করেছে, ওর ছবি পরিচালনা করতে বাধা কোথায়? এ দেশের অনেকে তো সমিতির সদস্যপদ না নিয়েও ছবি পরিচালনা করেছে এবং এখনো করছে। তখন প্রায় সবাই একবাক্যে বলে উঠল— ‘ওকে শুধু বহিষ্কার করা হয়নি, ও এ ছবির কাজ চলাকালে এর আশেপাশেও থাকতে পারবে না। ’ আমি বললাম, এখানে দেখবে কে? বলল, ‘এখানে আশপাশে সমিতির লোক আছে। তারা দেখলে ওর আরও বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ’ জানি না কী ক্ষতি হতে পারত, তবে মধুমিতা হলের মালিক, ‘হল মালিক সমিতি’র সভাপতি, সেন্সর বোর্ডের সদস্য সেন্সর বোর্ডের সামনেই যদি তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে পারেন তাহলে রনি তো চুনোপুঁটি, তার হয়তো অনেক কিছু হতে পারত। পরদিন পরিচালক রনিকে আমার রুমে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে তোমার? ছেলেটির চোখের পানি দেখে আমি বুঝেছিলাম একজন শিল্পীকে তার সংগঠন কীভাবে গলা টিপে হত্যা করেছে। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। আমি জানি না কী এমন জঘন্য অপরাধ করেছিল রনি যার জন্য তার এই অমানবিক শাস্তি। যে সমিতি তার বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াবে সেই সমিতি কর্তৃক এই কঠোর নির্দেশনা! শুনলাম রনি নাকি বলেছে, ‘পরিচালক সমিতি একটা বেকারদের আড্ডাখানা। ’ এতে সমিতির সংঘবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে, তাই ওর ওপর এই কঠোর শাস্তি। আমি চিরকাল জানি একটি সিনেমা একজন পরিচালকের সন্তানতুল্য। আর তাই যদি হয় তাহলে সমিতি কর্তৃক নির্দেশ তার সন্তানকে তার পরিত্যাগ করতে হবে, এমনকি সে তার সন্তানকে দেখতেও পারবে না। সমিতির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল রনি। অন্তত আমি যত দিন ছিলাম তা স্বচক্ষে দেখেছি। সিনেমাটি রিলিজের পরে দেখলাম পরিচালকের টাইটেল প্লেটেও তার নাম নেই। পরে শুনলাম শামীম আহমেদ রনি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর কখনো সিনেমা নির্মাণ করবে না। যে সমিতির এই কর্মকাণ্ড আমি সেই সমিতির একজন সদস্য। জয় হোক আমার সমিতির।
এরপর পাবনা থেকেই শুনলাম আমাদের কিংবদন্তি নায়ক, নায়করাজ রাজ্জাক সাহেবের ছেলে একই অপরাধে অপরাধী। তার সদস্যপদ কী করা হবে এ নিয়ে সমিতির বাইরে আলাপ-আলোচনার মধ্যে পরিচালক গাজী মাহবুব সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য রাজ্জাক সাহেবের অবদানের কথা চিন্তা করে বিষয়টির সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান। আমাদের নির্বাচিত মহাসচিব নাকি তখন বলেছিলেন, ‘রাজ্জাক সাহেবের কী অবদান আছে আমাদের সিনেমা শিল্পে? তাকে অনেক অর্থবিত্ত দিয়েছে এই সিনেমা শিল্প। তিনি কী করেছেন ওই টাকা দিয়ে? তিনি কি একটা সিনেমা হল নির্মাণ করেছেন? তিনি কি ওই টাকা দিয়ে একটা স্টুডিও করেছেন? তিনি কি ওই টাকা দিয়ে একটা শুটিং স্পট করেছেন?’ শুনলাম পরে এই নিয়ে বাকবিতণ্ডা, হাতাহাতি, মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছিল। মামলা-মোকদ্দমা শেষ পর্যন্ত কত দূর গড়িয়েছিল তা জানি না। তবে এটুকু জানি, পরিচালক গাজী মাহবুব সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচিত সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তার সদস্যপদ হারিয়েছেন, বহিষ্কৃত হয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি থেকে। এ দেশের সিনেমায় অসামান্য অবদানের জন্য নায়করাজ রাজ্জাককে সরকার থেকে দেওয়া হয়েছে আজীবন সম্মাননা। আমার জানা মতে এ দেশের সর্বোচ্চ পদক হচ্ছে স্বাধীনতা পদক। সেই পদকও তিনি পেয়েছেন। আমাদের মহাসচিবের উক্তি অনুসারে তাহলে কি বাংলাদেশ সরকার ভুল করেছে? ভুল করেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? সিনেমায় অবদান বলতে পিকনিকে লাখ টাকা চাঁদা, সমিতির সোফাসেট, টেলিভিশন কিনে দেওয়া অথবা স্টুডিও কিংবা সিনেমা হল বানানোকেই বোঝায়? আমি ওই সমিতির একজন সদস্য। জয় হোক সমিতির।
পরিশেষে বলতে হয় এসব কারণেই বোধ হয় সিনেমার মানুষেরা বর্তমানে দ্বিধাবিভক্ত। সিনেমার সকল শ্রেণির পেশাজীবীকে নিয়ে গঠিত হতে যাচ্ছে আরেকটি ফোরাম। যদি ফোরামটি গঠিত হয় তাহলে কি সিনেমার কোন্দল আরও বাড়বে? আমি পরিচালক সমিতির একজন আজীবন সদস্য। তবুও ইতিমধ্যে আমার একটি সিনেমা নির্মাণের জন্য সমিতির প্রত্যয়নপত্র পাওয়ার আবেদন করেছিলাম। ছবিটির নাম ‘আমার স্বপ্ন আমার দেশ’। তা নিয়ে অনেক তুলকালাম হয়েছে। মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারে আমার সমিতির সম্মানিত মহাসচিব আমাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন। এ নিয়ে আমার অনেক কষ্ট। আমি সমিতির সদস্যপদ প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছিলাম। এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। কী হবে আমি জানি না। তবু জয় হোক আমার সমিতির। বেঁচে থাকুক আমার সিনেমা শিল্প।
লেখক : চলচ্চিত্র পরিচালক।

No comments