Breaking News

১৬-১৭ কোটি মুসলমান যা পারেনি, হিন্দুধর্মের সুখরঞ্জন বালী একাই তা দেখিয়ে দিয়েছেন


মিনার রশীদ
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭,বুধবার,
 জাতি আবারো বিশেষ বলয়ের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গোয়ার্তুমির কবলে পড়ছে। আদালত বনাম সরকারের মধ্যকার বাহাসটির পরিণতি কোন দিকে যাচ্ছেÑ তা এখনো ঠিকভাবে মালুম করা যাচ্ছে না। প্রধান বিচারপতি সিনহা সম্প্রতি পাকিস্তানের হাইকোর্টের রায়টি এবং রায়পরবর্তী প্রতিক্রিয়া আমাদের কর্তাব্যক্তিদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
পাকিস্তানের নির্দোষ উদাহরণের এই মোলায়েম ঢেউটিকে নিয়েও চেতনার সুনামি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এবার তাদের বিউগল মারাত্মকভাবে বেজে উঠেছে। আওয়ামী লীগের টপ টু বটম বেচারা বিচারপতির বিরুদ্ধে রণসজ্জায় সেজে গেছে।
এই বাহাসটি নিয়ে দু’টি ধারণা বা সন্দেহ সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকদের মনে উদয় হয়েছে। তাদের যারা এটিকে নাটক হিসেবে মনে করছেন, তারাও কিছু ঘটনার হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ কেউ মনে করছেন, আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অনিবার্য পরিণতি এটা। এই দু’টি সম্ভাবনার যেকোনো একটি হোক না কেনÑ দুটোর পরিণতিই জাতির জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারে। কোনো সভ্য দেশ দেশের প্রধান বিচারপতিকে এমন আরাম করে গালিগালাজ করে না। এ ধরনের অশুভ প্রবণতা একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ধরেই টান দেয়।
ব্যাপারটা শুধু গালিগালাজেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। শোকের মাস শেষ হলেই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার অভিনব হুমকি দেয়া হয়েছে! সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক যিনি আদালতের ছিটেফোঁটা সমালোচনার জন্য এ দেশের অনেক গুণীজনকে অপমানজনকভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, আদালতের ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর সেই সোনা মানিক এবার প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘তুমি শুধু প্রধান বিচারপতির পদ ছাড়বা না, তোমাকে দেশও ছাড়তে হবে।’ এই রায় পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা লিখে দিয়েছে বলেও এস কে সিনহার বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তারই একসময়ের এই সহকর্মী।
অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও এই দেশে গর্ব করার মতো দু’টি প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছিল। বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রথমটির মাজা প্রথমেই ভেঙে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়টির মাধ্যমে প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। রাজনৈতিক সমস্যা আদালতের মাধ্যমে সমাধান করতে গিয়ে এই সর্বনাশটি করা হয়েছে। এখন কাজ সারার পর এই প্রতিষ্ঠানটিকেও ধ্বংস করে দেয়ার প্রসেস শুরু করা হয়েছে।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার পথে আমরা হয়তো এগিয়ে যাচ্ছি। ‘সর্প হয়ে দংশন করে যারা আমাদের ওঝা হয়ে ঝাড়ছে’ তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্ভবত এটিই।
তবে মুশকিল হলো, এখন যিনিই আওয়ামী লীগের অপকর্ম নিয়ে মুখ খুলবেন, তিনিই ‘রাজাকার’ হয়ে পড়বেন। এর সর্বশেষ ও ইউনিক উদাহরণ বা ভিক্টিম হলেন বাংলাদেশের প্রথম অমুসলিম প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি নতুন করে আসলে কিছুই বলেননি। কোটি মানুষের অভিজ্ঞতায় এসব ধরা পড়ছে এবং সবার মনে কথাগুলো নিত্য অনুরণিত হচ্ছে। তার এ কথাগুলো বিভিন্নভাবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অনেকবার উচ্চারণ করেছে। কিন্তু সরকার এসব মন্তব্য সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিজের ঢোল নিজে পিটিয়েছে। এখন আদালতের পর্যবেক্ষণ সরকারের এ যাবৎকালের সব জারিজুরি ফাঁস করে দিয়েছে। উন্নয়নের ফানুস ফুটো করে দিয়েছে। এটা নাটক হয়ে থাকলেও এই জায়গায় এসে নাটকের স্ক্রিপ্টে মারাত্মক গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। যাত্রাপালায় থাপ্পড় মারলেও (কখনো কখনো বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে) তার ব্যথা আসল থাপ্পড়ের চেয়ে কখনোই কম হয় না।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, এগুলো প্রকৃতির এক ধরনের প্রতিশোধ। বিশ্বাসীদের জন্য এসব আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। ভয়ভীতি দেখিয়ে এ দেশের বেশির ভাগ মুখকে চুপ করিয়ে ফেলানো হয়েছে। এখন এমন মুখ থেকে এমন কথা বের হয়েছে, যা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। মানুষের মুখ কখনোই পুরোপুরি স্তব্ধ করে দেয়া সম্ভব হয় না। কেউ না কেউ কথা বলে বসে।
এক স্ত্রী তার স্বামীকে প্রশ্ন করে বসেন, ‘আচ্ছা মুন্সি সাব, একটি প্রশ্নের জবাব দেন তো দেখি। আপনি আমাদের সবাইকে পশ্চিমদিকে মুখ করে প্রশ্রাব পায়খানা করতে নিষেধ করেন। কিন্তু নিজে একটু চাপে পড়লেই দেখি দিব্যি পশ্চিমমুখী হয়েই কাজটি সেরে ফেলেন!’
মুন্সি সাহেব বেয়াড়া স্ত্রীর এ ধরনের প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। ছিঁচকে এক মোক্তারের মাইয়াকে তার মতো বিখ্যাত মুন্সি ঘরে তুলে খাস গিন্নি বানিয়েছেন। সে কি-না করে এই প্রশ্ন! এই মুন্সির মেজাজমর্জি দেমাগ অনেকটা সরকারের মতো হয়ে পড়েছে। সামনে সুযোগমতো দুদক (মুন্সির ছোট বোন) দিয়ে পাকড়াও করতে হবে। রাগে কটমট করে অত্যন্ত বিরক্তভরে মুন্সি বলেন, ‘চুপ কর মাইয়া মানুষ। আমরা যা পারি, তোমরা তা পারো না।’
এই মুন্সির মতোই ভাব হয়েছে এ দেশের একটি দলের। তারা যা পারে, অন্যেরা তা করতে পারে না। এই মুন্সিদের ভেতরে এমন বিশেষ কিছু কলকব্জা রয়েছে, যা ভেতর থেকে এরা ঘুরিয়ে দিতে পারে। সত্যিই আজব চিড়িয়াখানা আমাদের রাজনীতির বিশেষ মুন্সিরা।
বিচারপতি খায়রুল হক যখন ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে ঘোষণা করলেন, তখন এই মুন্সিরা সুপ্রিম কোর্টের বাণীকে ঐশী বাণীর চেয়েও অলঙ্ঘনীয় হিসেবে ঘোষণা দিলেন। সেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দোহাই দিয়ে একটি মীমাংসিত বিষয়কে আবারো বিতর্কিত করা হলো। গণতন্ত্রের পথে আমরা যতটুকু এগিয়েছিলাম, এই একটি রায়ের মাধ্যমে ততটুকু পিছিয়ে দেয়া হলো। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সব যুক্তি ও শুভবোধ এই রায়ের কাছে অসহায় হয়ে পড়ল।
আদালতের সেই আদেশ মানতে তখন সে কী তাড়াহুড়ো, সে কী উত্তেজনা! যারাই এ রায় সম্পর্কে কিছু বলতে গেছে, তাদেরই ঠোঁটে আঙুল ছুয়ে পাপ পাপ বলে সতর্ক করে দিয়েছেন নানা রঙের মুন্সিরা। এ রায় নিয়ে গঠিত অ্যামিকাস কিউরিসহ দেশের তাবত ইন্টেলেকচুয়াল, সরকারের বাইরের সব রাজনৈতিক দল, এমনকি নিজেদের দল থেকে যে সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাদের সুপারিশও গ্রহণ করা হলো না।
আদালত অবমাননা বিষয়টি কিছু দিন আগেও এ দেশে এক আতঙ্কের নাম ছিল। ওই অপরাধে দেশের নামী-দামি লেখক, টকশোর বক্তা ও দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই আদালতকর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছেন। অনেককেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আদালতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ আদালতের কাছে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। এসব করতে নারাজ বেয়াড়া টাইপের দুয়েকজন জেলও খেটেছেন। মাহমুদুর রহমানের বেলায় আদালত সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। The truth is no defence. শুধু সত্য নয়Ñ কারো কারো জন্য সারাক্ষণ গান্ধীর বেশভূষাও এই বেলায় ডিফেন্স হিসেবে কাজে লাগেনি। অথচ আজ অধিসর Awami league is the best defense হয়ে পড়েছে। আদালতের বিরুদ্ধে সত্যকথন বা মহাত্মা গান্ধীর বেশভূষাও যা পারেনিÑ আজ বিশেষ কালো কোট সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে।
এই কালো কোট ধারণ করে আদালতকে এখন শুধু মোলায়েম সমালোচনা নয়Ñ এই জমানার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও মর্মপীড়াদায়ক বিশেষণÑ রাজাকার বলে গালি দেয়াও সম্ভব হয়ে গেছে।
কৃষ্ণের বেলায় লীলাখেলা অন্যের বেলায় পাপ। এখন আর এই বিশেষ মুন্সিরা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে বা দায়িত্বরত মাননীয় বিচারপতিদের সমালোচনা করলেও কোনো পাপ হবে না। বরং আদালতকে এ ধরনের হুমকি ধমকি আওয়ামী লীগের পক্ষে যাচ্ছে বলে তাতে বহুত বহুত সওয়াব হচ্ছে।
এই মহতী কাজটির শুভ সূচনা করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে আইন কমিশনে বিশেষ পুরস্কার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত খায়রুল হক। দেশের বিচারব্যবস্থা এবং রাজনীতিকে বর্তমান অস্থির অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি এককভাবে দায়ী হলে ইনি হলেন সেই ব্যক্তি।
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এই মহারথীকেই ব্যবহার করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে গালি দেয়ার কায়দা বা সাহস তিনিই দেখিয়ে দিয়েছেন। এই ফতোয়াটি তিনিই বাদবাকি মুন্সিদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বিচারপতি খায়রুল হকের সমালোচনা স্পষ্টভাবেই আদালত অবমাননা। কিন্তু উনার কিছুই হয়নি দেখে আওয়ামী লীগের মামুরা মহা আমোদভরে প্রধান বিচারপতিকে গালি দিতে শুরু করেছেন।
আমির হোসেন আমু বলেছেন, তুমি একটা ছিঁচকে উকিল, তোমাকে আমরাই প্রধান বিচারপতি বানিয়েছি। এ দিকে আওয়ামী লীগের অপু উকিল শুধু তাকে রাজাকারের অপবাদ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাকে হিন্দু ধর্ম থেকেও খারিজ করে দিয়েছেন। তিনি ফতোয়া জারি করেছেন, এস কে সিনহা হিন্দু নন। তিনি এমন কী দেখলেন যাতে তার কাছে মনে হয়েছে সিনহা হিন্দু নন? অপু উকিল হিন্দুশাস্ত্রে পণ্ডিত বলে কোনো দিন শোনা যায়নি। কিসের ওপর ভিত্তি করে অপু উকিল এই ফতোয়া দিলেন, তা নিয়ে নেট জগতে তুমুল গবেষণা শুরু হয়েছে। কে হিন্দু আর কে মুসলিম, এটা কারো গায়ের বাইরে কোথাও লেখা থাকে না। আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বললেই বা কোনো বিচারকের রায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেলেই তার ধর্ম বা হিন্দুত্ব নষ্ট হওয়ার কথা নয়। বেদ বা গীতায় কোথায়ও এই শর্তটি লেখা নেই।
প্রধান বিচারপতি বৃহত্তর আওয়ামী ঘরানার বাইরের কেউ ছিলেন না। বোধ হয়, এখনো তিনি তা নন। এ পর্যন্ত তার বেড়ে ওঠা এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ সবই আওয়ামী লীগের আনুকূল্যে হয়েছে, তাতে আর রাখঢাক বলে কিছু নেই।
সেই স্কাইপি সংলাপ থেকে হাছান মাহমুদ এবং আমুদের সাম্প্রতিক উচ্চারণÑ সব জায়গাতেই এই আনুকূল্য বা বিশেষ জ্যাকিংয়ের ছবিটি স্পষ্ট হয়েছে। ‘আমি খাড়ায়া পড়মুÑ আফনে বসায়া দিবেন’ এই সূত্র মতেই এ যাবৎকালে এ দেশের রাজনীতি ও বিচারালয় পরস্পরের হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু এবার খাড়ানোর পর কেন বসানো যাচ্ছে নাÑ সেটা পর্যবেক্ষক মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। খাড়ানো খাড়ানো খেলতে খেলতে এবার কি তাহলে বিবেক সত্যি খাড়া হয়ে পড়েছে?
এই বিবেক কিভাবে খাড়া হয় তা আমরা দেখেছি সুখরঞ্জন বালীর ক্ষেত্রে। তাকে তৈরি করা হয়েছিল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য। কিন্তু বিশেষ সেফ হোম বা ‘তন্তর-মন্তর’ রুমে সুখরঞ্জন বালীর বিবেক ‘খাড়া’ হয়ে পড়ায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। সেই বালীকে থামাতে প্রকাশ্য দিবালোকে কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে হাইজ্যাক করতে হয়। দেশের ১৬-১৭ কোটি মুসলমান যা পারেনি, হিন্দুধর্মের সুখরঞ্জন বালী একাই তা দেখিয়ে দিয়েছেন। তার বিবেক ও বিশ্বাসের জোর সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। সরকারবান্ধব মিডিয়া ও সুশীলকুল নিজেদের সান্ত্বÍনা দিয়েছে এই বলে যে, জামায়াত-শিবিরের টাকা এ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। কিন্তু টাকাই যদি এটা সম্ভব করতে পারত, তবে সরকারপক্ষ হতদরিদ্র সুখরঞ্জনকে টাকা দিয়ে এই কাজটি করাতে পারল না কেন, সেটাও বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। 

তর্কের খাতিরে যদি ধরা হয়, জামায়াত-শিবির তাদের অর্ধেক রাজত্ব সুখরঞ্জন বালীকে লিখে দিয়ে এই কাজটি করিয়েছিল, তবে সেই একই কাজ ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত (অপু উকিলের কথা মতো) একজন হিন্দুকে দিয়ে সরকারপক্ষ তা পারে না কেন? আকবর ও বীরবলের কথোপকথনের মতো চরমভাবে বিব্রত সরকারপক্ষ পুরো রাজত্ব সুখরঞ্জন বালীকে লিখে দেয়ার জন্য যে প্রস্তুত ছিল, তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। সত্যিকারের বিবেক জাগ্রত হলে একজন মানুষ কেমন আচরণ করে, এ বিষয়টি সম্ভবত তাদের সফটওয়্যারে ইনস্টল করা নেই। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে তারা সব সময় ভুল বার্তা গ্রহণ করে। একজন বিবেকবান মানুষের কাছে সারা দুনিয়ার দাম একটি মশার ডানার সমতুল্য নয়। সুখরঞ্জন বালীদের এই অগাধ বিশ্বাসের কারণেই পৃথিবী আজও এত সুন্দর ও মোহনীয়।

জানি না, একই কায়দায় একই সনাতন ধর্মের বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিবেক জেগেছে কি-না। পুরো বিষয়টি বুঝতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। এ ব্যাপারে এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।

সরকারের একান্ত ইচ্ছা, ২০২১ সালে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ক্ষমতায় থেকে উদযাপনের জন্য।
এ অবস্থায় বর্তমান অবৈধ শাসনকে ২০১৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে আরেকটু গ্রহণযোগ্যতা দিতে এটি আরো বড় কোনো নাটকের অংশ কি-না সেটাও তখনই স্পষ্ট হবে।

এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবার মনোযোগ এড়িয়ে গেছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দুই মাস আগে নেদারল্যান্ডসের হেগ সফর করেছিলেন। পরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের বরাত দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে একটি প্রেস রিলিজ বাংলাদেশী মিডিয়ায় দেয়া হলো। সেখানে বলা হয়, রোম সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অঙ্গীকার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারহীনতার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের প্রশংসা করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট। কিন্তু সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের কাছে লিখিতভাবে বিষয়টির প্রতিবাদ জানালে বিব্রত হয় বাংলাদেশ সরকার, সাথে সুপ্রিম কোর্ট ও সংশ্লিষ্টরা। মিডিয়ায়ও সেই খবর এসেছে। এরপর লজ্জায় সেই প্রেস রিলিজটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ।

আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট তাদের বার্তায় ভদ্র ভাষায় বলেছেÑ International Criminal Court correcting misleading media reports. এটা আমাদের নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘বাহে, যে কথাটি কস্মিনকালেও উচ্চারণ করি নাই, সেই কথাটি আমাদের বলে প্রচার করে যাচ্ছ।’

তারা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আইসিসি প্রেসিডেন্ট কিংবা ডেপুটি প্রসিকিউটর বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার কিংবা বাংলাদেশের কোনো কোর্টে পরিচালিত অন্য কোনো বিচার নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কোনো মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত বিষয় তাদের নাম দিয়ে প্রচার করায় আইসিসি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানি না, জাতির কান আরো কাটা যাওয়ার বিষয়টি এখনো নিজেদের উপলব্ধিতে টানতে পারছেন কি-না। আদালত অবমাননার জন্য এ দেশের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকে আদালতে তলব করা হয়েছে। অনেকের জেল-জরিমানাও হয়েছে। কাউকে কাউকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কাজেই যে মিডিয়া শুধু সর্বোচ্চ আদালতের নয়, পুরো জাতির কান কেটেছে তার এখন কী করা উচিত?
এখন চুপি চুপি প্রেস রিলিজ ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে দিলেই এই ইজ্জত রক্ষা পাবে না। এই প্রেস রিলিজ কেন দেয়া হয়েছিল এবং এখন কেন সরানো হলো তারও একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেয়া উচিত।

আদালত বনাম সরকারের মধ্যকার এই বাহাসের মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। অথচ এর মাধ্যমে সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগকে অত্যন্ত খেলো করে ফেলা হয়েছে।

সরকারপক্ষ কিংবা বিরোধীপক্ষÑ কেউ বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না। কোনো মিডিয়াতেও বিষয়টি আলোচনায় আসছে না। সরকারপক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতিকে ছিঁচকে উকিল, রাজাকার ইত্যাদি নামে ডাকা হলেও ICC এর প্রতিবাদটি নিয়ে কাউকে বিব্রত করা হচ্ছে না, বরং একটি বাহাস সৃষ্টি করে সারা দেশ ও বিরোধী দলকে ব্যস্ত করে ফেলা হয়েছে।
বিষয়টি অধিকতর মনোযোগ দাবি করে। সরকার কি একটি বড় ক্ষতিকে ঢাকতে গিয়ে এই বাহাসটি সাজিয়েছে?

তবে বাহাসটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত এটাকেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। এটাকেই বলা হয় ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’। সেই দড়িটি এখন কিভাবে গলায় পরে কিংবা কিভাবে এই দড়িটি গলা থেকে বের করা হয়, তাই দেখার বিষয়।

No comments