বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে বিতর্কিত দিক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চতর আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। উচ্চ আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এ ধরনের নিয়োগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী। সত্যিকার অর্থে, বিষয়টি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নয়, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে প্রশংসিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে বিতর্ক সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতার যে মানদণ্ড থাকে তা অনেক সময় সাময়িকভাবে পরিবর্তন করা হয় অথবা আবেদনকৃত প্রার্থীদের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী নিয়োগ পান।
সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর বিষয়ে যেসব প্রার্থী প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় স্থান অধিকার করেন, সেসব প্রার্থীর নিয়োগ পাওয়া উচিত। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সময় এ বিষয়টি গুরুত্ব পেত। উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে ধারণাটি ফুটে উঠেছে। প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি উত্থাপিত হয় তা হচ্ছে- ‘শুধু প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীরাই বেশি মেধাবী, নাকি এর পরবর্তী মেধাস্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থী যারা নিয়োগের শর্ত পূরণ করেছেন, তারাও যোগ্য?’ এ প্রশ্নটির কোনো পরম বা এক কথায় উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। বিষয়টি আপেক্ষিক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়।
একটি বিভাগের কোনো একটি বর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধার পার্থক্য খুবই নগণ্য। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, প্রথম বর্ষে প্রায় এক চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী ক্লাস ও পরীক্ষায় বিশেষভাবে মনোযোগী হয়। দ্বিতীয় বর্ষে এর পরিমাণ কমে যায় এবং এর পরে পাঁচ-সাতজন শিক্ষার্থী পঠিত বিষয়ে গভীর ও ব্যাপক ধারণা লাভের জন্য আগ্রহী হয়। অন্যান্য শিক্ষার্থী মধ্যম মানের পড়াশোনা করে যাতে একটি সম্মানজনক ফলাফল করে ডিগ্রি নিতে পারে। এরা অন্যান্য পড়াশোনা (পাঠক্রমবহির্ভূত) করে, যাতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে। কিছু শিক্ষার্থী বিষয়ভিত্তিক ও পাঠক্রমবহির্ভূত পড়াশোনায় তেমন আগ্রহী নয়।
আমার অনেক সহপাঠী যারা বিষয়ভিত্তিক ফলাফল খুব বেশি ভালো করেনি, তারা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। আমার নিজের শিক্ষার্থীর মধ্যেও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। সুতরাং বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে যারা প্রথম সারিতে এবং যারা প্রথম সারিতে নয়, তাদের মধ্যে মেধার পার্থক্য খুবই সামান্য। পার্থক্য হচ্ছে- বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা ও ব্যাপকতা। যেহেতু প্রভাষক নিয়োগের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকতা ও গবেষণা, সেহেতু ভালো ফলাফলধারী প্রার্থী নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। নিয়োগপ্রক্রিয়ার সময় আরেকটি মানদণ্ড লক্ষ করা যায়। তা হলো- ‘উচ্চতর ডিগ্রিধারী প্রার্থীর ক্ষেত্রে যোগ্যতার শর্ত শিথিলযোগ্য’। এ ক্ষেত্রে যেসব প্রার্থী উচ্চতর ডিগ্রির ক্ষেত্রে কোর্সওয়ার্ক ও গবেষণা দুটোই করেছেন, তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের কিছু জায়গায় উচ্চতর ডিগ্রির ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রি শুধু গবেষণার ভিত্তিক দেয়া হয় এবং পার্টটাইম গবেষণা করার সুযোগও আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, আমাদের দেশে গবেষণার মান কাক্সিক্ষতপর্যায়ে নয়।
এ ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রিধারী প্রার্থী একটি নির্ধারিত বিষয়ে গবেষণার ভিত্তিতে জ্ঞানার্জন করলেও সার্বিকভাবে পুরো ডিসিপ্লিনের প্রতিটি দিকে জ্ঞানার্জনে ঘাটতি থেকে যায়। সুতরাং ‘উচ্চতর ডিগ্রিধারী প্রার্থীদের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলযোগ্য’ বিষয়টি প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিতর্কিত। আরো একটি কথা নিয়োগের পর শোনা যায় ‘ভালো ফলাফলধারী প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করেননি অথবা কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করেছেন।’ যখনই কোনো নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যোগ্যতার মাপকাঠি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখনই বেশির ভাগ সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য শোনা যায়। হ্যাঁ, হতে পারে, কোনো প্রার্থী ১০-১৫ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষায় আশানুরূপ উত্তর দিতে পারেনি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, মৌখিক পরীক্ষায় অনেক সময় পাঠক্রমবহির্ভূত সাধারণ জ্ঞান ও অন্যান্য প্রশ্নও করা হয়।
এ ধরনের বক্তব্য আমরা যারা শিক্ষকতা করি এবং শিক্ষার্থীর মেধা মূল্যায়ন করে অ্যাকাডেমিক ফলাফল প্রস্তুত করি, তাদের পরোক্ষভাবে হেয় করে। যে শিক্ষার্থী চার বছর স্নাতকপর্যায়ে ও এক বছর স্নাতকোত্তরপর্যায়ে লেখাপড়া করে বিভিন্নপর্যায়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা তালিকার প্রথম দিকে স্থান করে নিলো, মাত্র ১০-১৫ মিনিটের একটি মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে তার পাঁচ বছরের অর্জনকে ম্লান করে দেয়া হবে কেন? পরোক্ষভাবে আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো যেন, আমরা সঠিকভাবে পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছি। এ ধরনের নিয়োগপ্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। এ জন্য শিক্ষার্থী বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনায় অমনোযোগী ও অনাগ্রহী হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে, স্নাতকপর্যায়ে ভালো ফলাফল করেও স্নাতকোত্তরপর্যায়ে গবেষণায় খুব বেশি সময় না দিয়ে পাঠক্রমবহির্ভূত জ্ঞানার্জনে ব্যস্ত থাকে অনেকেই।
এতে তার গবেষণাবিষয়ক শিক্ষা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাচ্ছে। ইদানীং স্নাতকপর্যায়েও ক্লাসে প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের গভীরে যাওয়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। সিস্টেমের কারণে কেউ না কেউ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইত্যাদি মেধাস্থান অর্জন করছে। তথাপি তাদের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানী লোকের সরবরাহ দিন দিন কমে যাবে, যা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশেষ প্রবণতা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। এ জন্য বিভিন্ন সময় টার্গেটকৃত শিক্ষার্থীকে নিয়োগের ব্যাপারে অশুভ ও অনৈতিক প্রক্রিয়া অবলম্বনের অভিযোগ ওঠে। আবার যেহেতু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা কোনো একটি পদের জন্য প্রার্থী হন, সেহেতু তাদের মধ্যে মেধার সমন্বয়ের বিষয়ে একটি সমস্যা তৈরি হয়। এ জন্য একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক নিয়োগের সনদ দেয়া যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এটা যেন কোনোভাবেই প্রচলিত, বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার অনুরূপ না হয়। আমরা অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে অনুসরণ করি।
প্রয়োজনে এ ব্যাপারে ভারতীয় ইউজিসির পরামর্শ নেয়া যায়। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার জন্য National Eligibility Test (NET)-এর ব্যবস্থা আছে। যেখানে ঘঊঞ সনদধারী প্রার্থী না পাওয়া যায় সেখানে State Level Eligibility Test (SLET) অথবা পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থী নিয়োগ দেয়া হয়। মোট কথা, প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদণ্ড আরোপ করে যোগ্য প্রার্থীর সেট যথাসম্ভব ছোট করা আবশ্যক। এতে যে প্রার্থীই নিয়োগ পান না কেন, তিনি মেধাবী ও যোগ্য হবেন। আর এ ক্ষেত্রে দলপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি বা স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করা যায়। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দলমত নির্বিশেষে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা অতীব প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
No comments