প্রশংসার ফাঁদ পেতেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা।
বিশ্লেষকদের অনেকে। যুগান্তরকে তারা বলেন, সিইসির কাজ আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জনমনে আস্থা তৈরি করা। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে তা দূর করতে কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগী হওয়া। কিন্তু এভাবে এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর মতো চটুল বক্তৃতা দেয়ার কাজ সিইসির নয়।
জনতার মঞ্চের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে যুগ্মসচিব থাকা অবস্থায় বর্তমান সিইসিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। পরে আদালতের রায়ে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়ে সচিব হন কেএম নুরুল হুদা। আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করার পর তাকে সিইসি হিসেবে নিয়োগ দেয়। সে সময় কেএম নুরুল হুদার নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে বিএনপি। এখন সেই সিইসির মুখে বিএনপির ব্যাপক প্রশংসা সবাইকে রীতিমতো হতবাক ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে। বিষয়টি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি হিসেবে পরিণত হয়েছে বললেও ভুল বলা হবে না। তবে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সোমবার সিইসির সংলাপ থেকে ওয়াকআউট করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী। জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা বলায় সিইসির সঙ্গে সংলাপে বসেও শেষ সময়ে তা বয়কটের ঘোষণা দিয়ে বের হয়ে আসেন তিনি। কাদের সিদ্দিকী এ সময় সিইসির পদত্যাগও দাবি করেন।
সিইসির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, ‘সিইসি বিএনপিকে খুশি করার জন্য হয়তো এসব কথা বলেছেন। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। সামনে নির্বাচন। তার ওপর অনেক দায়িত্ব। স্বভাবতই নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলেছেন, বলবেন। এ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে জিয়াউর রহমানের শাসনামল অবৈধ- এটা আদালত কর্তৃক স্বীকৃত। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে সামরিক লেবাসধারী একজন ব্যক্তি কখনও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হতে পারেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে সত্যিকারের বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে নব্বইয়ের পর। আর খালেদা জিয়ার শাসনামলে খুন-গুম, সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, হাওয়া ভবনের আবির্ভাব মানুষ তো ভুলে যায়নি। তবে বাকশাল করার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তখনকার বাস্তবতায় শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন এনেছিলেন। সেই সময়কার যুবফ্রন্টের সদস্যদের মধ্যে আমিও একজন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাকশালে সব দলই ছিল, সুতরাং ওটাকে একদলীয় শাসন বলা যাবে না।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘সিইসি ব্যক্তিজীবনে একজন আমলা ছিলেন। সাধারণত আমলাদের চরিত্র হচ্ছে সবাইকে তুষ্ট করে চলা। এ চরিত্র থেকেই হয়ত তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসে তাদের তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। আগে থেকে বক্তৃতা লেখা থাকে, সংলাপে বসে তিনি সেই বক্তৃতা পাঠ করেন।’ তিনি বলেন, ‘সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করছেন তার কোনো গুরুত্ব নেই। পুরো বিষয়টি লোক দেখানো। তার আসল কাজ হচ্ছে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। এখনও সেরকম উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কার্যকর উদ্যোগ না দিয়ে রাজনীতিকদের মতো স্রেফ মেঠো বক্তৃতা দিয়ে লাভ হবে না।’
সিইসির বক্তব্যকে ইতিবাচক মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। তিনি সফল রাষ্ট্রপতি ছিলেন। খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তার শাসনামলে দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। সিইসির এই স্বীকৃতি এবং তার এসব কথা বলার মধ্য দিয়ে তিনি একটি উদাহরণ সৃস্টি করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের আস্থায় আনতে চেয়েছেন। আমরাও তাকে আস্থায় নিয়ে আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চাই। কিন্তু সিইসি তার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজটা কতটা করতে পারবেন, বা তাকে কাজটা করতে দেয়া হবে কিনা- তা সময়ই বলে দেবে। যদি তিনি পারেন ইতিহাসে তার নাম নায়ক হিসেবে লেখা থাকবে। না পারলে ভিলেন হিসেবেই থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সিইসি কি চান তার অধীনে আরেকটি ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন হোক? যদি তা না চান তাহলে তাকে সাহসী হতে হবে। সাংবিধানিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।’ বিএনপির শাসনামলে চাকরিচ্যুত কেএম নুরুল হুদার মুখে বিএনপির প্রশংসা, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘ভেতরের কারণ কী আছে বা নেই তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে তিনি তো সত্যিটা স্বীকার করেছেন। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, তিনি কথা ও কাজের মধ্যে কতটা মিল বজায় রাখেন। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে কী ভূমিকা পালন করেন। এই সিইসির হাত ধরে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হবে, নাকি গণতন্ত্রের কবর চিরতরে রচিত হবে- সেটাই এখন দেখার পালা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘দেশের রাজনীতি এখন স্বাভাবিক না। একেবারেই স্বাভাবিক না। এ অবস্থায় নিজের ক্ষমতা ও দায়িত্বের বাইরে গিয়ে সিইসি কাজ করছেন। যে কাজ তার না, তিনি সেই কাজ করছেন। বৈঠকের নামে রাজনৈতিক দলের প্রশংসা করছেন। এটা তার চালাকি বলেই মনে হয়। বিএনপিকে ভোটে আনার ফাঁদও মনে হয়। সীমার বাইরে গিয়ে এ ধরনের চালাকিতে কিংবা ফাঁদ পেতে কোনো কাজ হবে না- যদি না আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিইসির বিরুদ্ধে একটি দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্যের অভিযোগ রয়েছে। প্রথম থেকেই এ কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় জনগণের আস্থা অর্জনে তাদের প্রয়োজন নিরপেক্ষ আচরণ করা। নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করতে যেসব বাধা আছে তা দূর করা। পর্যাপ্ত বিধি-বিধান তৈরি করা। বিধি-বিধান না থাকলে সরকারকে তৈরি করতে বলা। নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করা। কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত ভোটের নিশ্চয়তা দেয়া। এসব হচ্ছে কমিশনের আসল কাজ। তা না করে তারা স্টান্টবাজি করছেন। চাতুরতার আশ্রয় নিচ্ছেন। কোন দল, কে কী করেছে- এসব বলার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের মতো বক্তৃতা দিচ্ছেন।’
আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘কোনো দলের পক্ষে বা ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গাওয়া সিইসির কাজ না। প্রশংসা করলেই বিএনপি নির্বাচনে চলে আসবে- সিইসি যদি এমনটা ভেবে থাকেন, তাহলে বলব তার এ ভাবনা অবান্তর। বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি, এটাই বাস্তবতা। মাঠে-ঘাটে একটা কথা সবাই বলছেন- ভোট হবে, বিএনপি সেই ভোটে অংশ নেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসবে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও বারবার এ কথা বলছেন। এ থেকেই বোঝা যায় আগামী নির্বাচন কেমন হবে।’
তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় ভোট যে সুষ্ঠু হবে জনমনে সেই আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। কমিশনকে তার কাজের মধ্য দিয়ে সেই আস্থার জায়গা সৃষ্টি করতে হবে। ভাঁওতাবাজি করে, চালাকি করে, বেশি কথা বলে, রাজনীতিকদের মতো বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে জনমনে আস্থা তৈরি করা যায় না। বরং এ চালাকির পরিণাম হিতে বিপরীত হবে।’
আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘সিইসি কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে বললে এতে ভোট এবং ভোটার দুটোই প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই তার উচিত এ ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত থাকা।’
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘ভালো কিছু কথা বলে কারও সঙ্গে আলোচনাটা শুরু করলে এতে কিছুটা সুবিধা হয়, ইতিবাচক আবহ তৈরি হয়- এমন চিন্তা থেকেই হয়তো সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে তাদের প্রশংসা করেছেন। আর প্রশংসা কার না ভালো লাগে? প্রশংসা শুনলে মনটাও ভালো থাকে। তবে আগ বাড়িয়ে প্রশংসা করাটাও সন্দেহজনক। নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদিও সিইসি যে কেবল বিএনপিরই প্রশংসা করেছেন তা নয়, জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলোরও প্রশংসা করেছেন। তাই এ বিষয়টিকে আমি নেতিবাচকভাবে দেখতে চাই না। তবে সিইসিকে মনে রাখতে হবে, তার ওপর নির্ভর করছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। সব দলের অংশগ্রহণে তাকে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে হবে। দেশবাসী এমন একটি নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। তাই কথার চাইতে কাজকেই তাদের বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। ভোট অবাধ এবং সুষ্ঠু করার পথে বাধাগুলো দূর করতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের এখানে সমালোচনা করা মানেই শক্র বলে গণ্য হওয়া। সিইসি হয়তো এ চিন্তা মাথায় রেখেই সমালোচনার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনার জন্যই হয়তো তিনি তাদের প্রশংসা করছেন। এখানে আমি দোষের কিছু দেখছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে মনে রাখতে হবে, নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজই হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া। এখন দেখার বিষয়, তারা তাদের এ কাজটা সঠিকভাবে করতে পারছেন কিনা।’
No comments